Friday, April 12, 2013

Read online "Women In Islam" (bengali, arabic)

ইসলামে নারী
বনাম
পুস্তক ও বাস্তবতায় ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মে নারী
রচনায়:
ড.শারীফ আব্দুল আজীম
পি.এইচ.ডি (কুইন বিশ্ববিদ্যালয়)
কিংস্টোন,ওন্টারিও,কানাডা
অনুবাদ:
মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়
কায়রো,মিশর
অনুবাদকের কথা
الحمد لله رب العلمين- و الصلاة و السلام على من لا نبى بعده- و على آله و أصحابه و بارك و سلم- أما بعد
আমাদের সমাজের লোকেরা ইসলাম সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনে ইসলামের নামে অনেক অপবাদ আরোপ করে বসে যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের সঠিক জ্ঞান থাকলে তারা এটা বলত না। এ ধরণের বিষয়গুলোর মধ্যে নারীর অধিকার একটি। তারা বলে থাকে ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে তার প্রমাণ নিকটাত্মীয়ের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীর অংশ পুরুষের অর্ধেক। এছাড়াও তারা বলে ইসলাম পুরুষকে চারটি বিবাহের অনুমতি দিয়েছে অথচ, নারীকে একটির বেশী বিবাহের অনুমতি দেয় নি। এখানেও নাকি নারীকে ঠকানো হয়েছে ইত্যাদি হাজারো অভিযোগ তাদের ইসলামের বিরুদ্ধে। তারা কি কখনো এগুলোর পিছনের কারণগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছে? কেন নারীকে পুরুষের অর্ধেক অংশ দেয়া হল? সব সময়ই কি নারীর অংশ পুরুষের অর্ধেক? তারা যদি এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তারা তার ভিতর দেখতে পাবে ন্যায় ও ইনসাফের অনন্য দৃষ্টান্ত। উত্তরাধীকার সম্পদেই আসি। নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবারের কোন খরচের দায়িত্ব দেয়া হয় নি। শশুর বাড়ীতে তার আত্মীয়-স্বজন আসলেও তাদের আপ্যায়নের জন্য তার চার আনা পয়সাও খরচ করতে হয় না। সন্তান সন্ততি লালন-পালনের খরচ তার করা লাগে না ইত্যাদি। এসব কিছুর দায়িত্ব তার স্বামীর। সে যেটুকু পায় তার সবই থেকে যায়। সবই আয় কোন ব্যয় নেই। পক্ষান্তরে, পরিবারের সর্বক্ষেত্রের ব্যয় স্বামীকে বহন করতে হয়। স্ত্রী যদি কোটিপতিও হয় তার উপর তার নিজের খরচ চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয় নি। বরং, তার খরচ চালানোর দায়িত্বও তার স্বামীর উপর ন্যস্ত। অপরদিকে, পুরুষেরা সাধারনত চারটি জায়গা থেকে উত্তরাধিকার সম্পদ পায়। পক্ষান্তরে নারীরা পায় ৮/৯ জায়গা থেকে। আর সব সময় তারা পুরুষের অর্ধেক সম্পদ পায় না; বরং কোন কোন জায়গায় তারা পুরুষের সমান পায় কোন কোন জায়গায় পুরুষ পায় না বরং তার স্থলে একই পর্যায়ের নারী থাকলে সে সম্পদ পায়। গড় হিসাব করতে গেলে তারা পুরুষের সমান; বরং পুরুষের চেয়ে বেশী পায়।
আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় পর্দা। এটা ইসলামের বানানো জিনিস নয়;বরং ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মেও পর্দার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বইয়ের ভিতর ইসলাম ধর্ম এবং ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মে নারীদের অবস্থান ও মর্যাদার চিত্র ও বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি পাঠকবৃন্দ এ বই থেকে উক্ত তিনটি ধর্মে বর্ণিত নারীদের অধিকার ও মর্যাদার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা জানতে পারবেন। পরিশেষে, সকল মুসলিম ভাইবোনের কাছে দোয়া চাচ্ছি আল্লাহ যেন আমাকে ভালো ভালো গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করে মুসলিম জনগোষ্ঠির দুয়ারে সহজভাবে পৌছে দেয়ার তাওফিক দান করেন। আমীন।
বিনীত
তাং: ১৬ মার্চ ২০১০ ইং মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর
সূচীপত্র
বিষয়
ভূমিকা
হাওয়া (আঃ) এর অপরাধ?
হাওয়া (আঃ) এর অপরাধের উত্তরাধিকার
কন্যা সন্তান কি অপমান ডেকে আনে
নারী শিক্ষা
ঋতুবতী নারী আশপাশের সব কিছুকে নাপাক করে দেয়?
সাক্ষ্যদানের অধিকার
ব্যভিচার
মান্নত করা
স্ত্রীর অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব
তালাক
মায়েরা
উত্তরাধীকার সম্পদে নারী
বিধবার সমস্যা সংকুল জীবন
বহুবিবাহ
পর্দা বিধান
শেষ কথা
সহায়ক গ্রন্থাবলী
ভূমিকা
পাচ বছর ধরে আমি "টরোন্টো স্টার" পত্রিকা পড়ছি। ১৯৯০ সালের ৩রা জুলাই গুইন ডায়েরের লেখা একটা প্রবন্ধ পেলাম " শুধু ইসলামই ঐশ্বরিক মতবাদ নয়" শিরোনামে। বিশিষ্ট্য মিশরীয় নারীবাদী ড.নাওয়াল আস-সা'দায়ীর মন্তব্যের বিপক্ষে মন্ট্রিয়ালে অনুষ্ঠিত "নারী ও ক্ষমতা" শীর্ষক কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের কার্যক্রমের জবাবে এটা লিখিত হয়েছে। তার কমেন্ট ছিল রাজনৈতিকভাবে ভূল। " নারী সংক্রান্ত সকল শিক্ষা ইহুদী ধর্মে পাওয়া যেত তারপর তা খৃষ্টান ধর্ম এবং পরবর্তীতে কুরআনে পাওয়া যায়।" এবং "সকল ঐশ্বরিক ধর্ম ঐশ্বরিক সমাজে উদ্ভাবিত হয়েছে।" হিজাবের বিধান শুধুমাত্র ইসলামেই আসেনি বরং তা পুরাতন যুগের ধর্মগুলোতেও পাওয়া যেত।" অংশগ্রহণকারীরা ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের সাথে একই কাতারে মেনে নিতে চায় নি। এজন্যই ড.নাওয়াল সা'দায়ী তাদের প্রচন্ড সমালোচনার শিকার হন। বিশ্ব মায়েদের আন্দোলনের প্রিন্স দুবো বললেন: সা'দায়ীর মতামত অগ্রহণযোগ্য। তিনি অন্যান্য ধর্মকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন নি। ইসরাইলের নারীবাদী সংগঠনের "আলেস শ্যালভী" বলেন: "আমাদের অবশ্য কর্তব্য তার কথার বিরোধিতা করা। কারণ, ইহুদী ধর্মে কোন হিজাব নেই।" এ প্রবন্ধে বলা হয় পশ্চিমাদের ইসলামের উপরে অপবাদ আরোপই পশ্চিমা সভ্যতার বিভিন্ন কার্যক্রমের স্রষ্টা
গুইন ডায়ের আরও বলেন: ইহুদী ও খৃষ্টান নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা মুসলমানদেরকে কখনো তাদের সমান মেনে নেবে না।"
কনফারেন্সে উপস্থিত সদস্যদের অবস্থান; বিশেষ করে নারী সংক্রান্ত অবস্থান আমার কাছে আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হয় নি। কারণ, পশ্চিমাদের কাছে ইসলাম "নারীর উপর জুলুমকারী ধর্ম" বলে বিবেচিত হয়। এর সবচেয়ে বড় দলীল হচ্ছে ভোল্টায়ারের দেশ ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী ফ্রান্সের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হিজাব পরিহিতা মহিলাদেরকে বিতাড়ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন! ১
এছাড়াও যখন কোন খৃষ্টান ছাত্র ক্রুশ ঝুলিয়ে এবং কোন ইহুদী ছাত্র তাদের টুপি পরে শিক্ষা গ্রহণ করছিল তখনই মুসলিম নারীরা তাদের হিজাবের অধিকার ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফ্রান্সের পুলিশ কর্তৃক হিজাব পরিহিতা মহিলাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশে বাধা প্রদানের দৃশ্য ভূলে যাওয়ার মত নয়। এটা "আলাবামা" প্রদেশের শাসক জর্জ ওয়ালাসের অপমানকর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৬২ সালে তিনি একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সেখানে প্রবেশে বাধা দিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে, উক্ত দুই ঘটনার মাঝে কিছুটা পার্থক্য ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররা আমেরিকানসহ সারা বিশ্বের সহানূভূতি অর্জন করার ফলে "প্রেসিডেণ্ট কেনেডী" তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করাতে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল। কিন্তু, মুসলিম নারীরা কারও কাছ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা পায়নি। ফ্রান্সের ভিতর বা বাইরে থেকে তারা কোন সহানুভূতি পায়নি। এটার কারণ হল ইসলাম সম্বন্ধে তাদের মধ্যকার ভূল বুঝাবুঝি ও ইসলাম সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ের প্রতি ভীতি। তবে, আমার সব মনযোগ কেড়ে নিয়েছে "ড. সা'দায়ীর বক্তব্য ও অন্যদের সমালোচনা" তা কি সত্য? অন্য কথায়, নারীদের এ বিধান কি ইহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম সব ধর্মে একই রকম? নাকি তাদের মাঝে কোন পার্থক্য আছে? ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম কি ইসলামের চেয়ে নারীদেরকে বেশী মর্যাদা দিয়েছে? আসল ঘটনাটা কি?
নিশ্চয়ই এ প্রশ্নগুলোর জবাব সহজ ব্যাপার নয়। প্রথমত: কঠিন ব্যাপার যে, আমাকে নিরপেক্ষ ও নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে; অন্ততঃপক্ষে সাধ্যমত তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা। মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছে সত্য কথা বলার জন্য যদিও তা তাদের নিকটস্থ লোকদেরকে নাখোশ করে। আল্লাহ্ বলেন:
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (152)
অর্থাৎ,যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায়সংগত কথা বলবে যদিও তা তোমাদের নিকটাত্মীয় স্বজনের বিপক্ষে যায়তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে নাও তিনি তোমাদেরকে এরই নির্দেশ দিয়েছেন;যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর(সূরা আনয়ামঃ ১৫২)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا-
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায় সংগত সাক্ষ্যদান কর; যদিও তা তোমাদের নিজেদের, পিতামাতা বা নিকটাত্মীয় স্বজনদের বিপক্ষেও চলে যায়। যদি সে ধনী বা গরীব হয় তাহলে,আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেয়েও তাদের অনেক বেশী শুভাকাংখী। অতএব, তোমরা ন্যায় বিচার করতে গিয়ে নিজেদের নাফসের কামনা বাসনার অনুসরণ করো না। (সুরা নিসা: ১৩৫)
আরেকটি কষ্টকর কাজ হল এ বিষয়টা অনেক প্রশস্ত এবং এর শাখা প্রশাখা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এ জন্য গত কয়েক বছর যাবত আমি বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বকোষ ও ইহুদী বিশ্বকোষ পড়াশুনা করেছি এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মের পন্ডিতদের ও সমালোচকদের লেখা পুস্তকাদি ব্যাপকভাবে পড়াশুনা করেছি। সামনের অধ্যায়গুলোতে আমি আমার গবেষনার সার সংক্ষেপ তুলে ধরব ইনশাল্লাহ
আমি সম্পূর্ণভাবে উক্ত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারিনি এবং হওয়ার দাবিও করি না; বরং, গবেষনার সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কুরআনের নির্দেশ অনুসারে আমি এ বিষয়ে ন্যায়সংগত ও নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করেছি। এমন কোন মুসলমান এ ধরায় পাওয়া যাবে না যে, মুসা ও ঈসা (আঃ) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল বলে বিশ্বাস করে না। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমি ইসলামকে সর্বপ্রকার অপবাদ থেকে মুক্ত করব এবং আল্লাহ তায়ালা যেন আমার দ্বারা সর্বশেষ জীবনবিধান ইসলামের খেদমত করান। তাই, তিনটি ধর্মে নারীদের মর্যাদা নিয়ে আমি মূল ধর্মগ্রন্থ গুলো থেকে রেফারেন্স নিয়ে এসেছি; অনেকের মত অন্যের অনুসরণ করে পক্ষপাতমুলকভাবে নয়। এ জন্যই অধিকাংশ সুত্র এসেছে- কুরআন, হাদীস, বাইবেল, তালমুদ এবং খৃষ্টান ধর্মের এমন কিছু পাদ্রীর বক্তব্য থেকে যাদের বক্তব্য খৃষ্টান ধর্মে অনেক বড় স্থান দখল করে নিয়েছে। এ ধর্মসমুহের অনেকেরই স্বভাব হচ্ছে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থের সঠিক শিক্ষা উপস্থাপন করতে চান না। অনেক মানুষ সভ্যতা ও ধর্মকে একাকার করে দেন। অনেকে আবার আসমানী কিতাবের কথা বুঝে উঠতে পারেন না। আর কিছু লোক আসমানী কিতাবের নির্দেশের দিকে একেবারেই ভ্রুক্ষেপ করে না।
হাওয়া (আঃ) এর অপরাধ?
তিনটি ধর্ম একটি সত্যের উপর একমত তা হল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুরুষ নারীকে সৃষ্টি করেছেন আর তিনিই সমস্ত পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। ধর্মগুলোর মধ্যে যতসব বৈপরিত্য হয়েছে সবই প্রথম মানুষ আদম হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির পর। ইহুদী খৃষ্টানদের বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা আদম হাওয়া (আঃ) কে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু, সাপ হাওয়া (আঃ) কে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ায় প্ররোচনা দিয়েছে আর হাওয়া (আঃ) আদম (আঃ) কে তা খেতে প্ররোচনা দিয়েছেন।(নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ তায়ালা যখন আদম (আঃ) কে অপরাধের জন্য দোষারোপ করেছেন তখন আদম (আঃ) তার সব দোষ হাওয়া (আঃ) কে দিয়ে বলেছেন: "অতঃপর আদম (আঃ) বললেনঃ ওই মহিলা আমাকে দিয়েছে তাই আমি তা খেয়েছি।" (জেনেসিসঃ/১২)
স্রষ্টা মহিলাদের সম্বন্ধে বললেন: "আমি তোমাদেরকে অনেক কষ্টের সন্মুখীন করব। সন্তান প্রসবের সময় ব্যথা পাবে; আর তোমার সমস্ত মনোনিবেশ হবে তোমার স্বামীর দিকে। যে তোমার উপর কর্তৃত্ব করবে। আর তিনি আদম (আঃ) কে বললেনঃ তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে আমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছ যার সম্বন্ধে আমি বলেছি পৃথিবীর অভিশপ্ত গাছ থেকে ভক্ষন করো না। এর কারণে দুঃখ-কষ্ট তোমার জীবনের দিনগুলিকে খেয়ে ফেলবে। (জেনেসিসঃ/১৬-১৭)
অপর দিকে সৃষ্টির শুরুর ঘটনাবলী নিয়ে কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন:
وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ (19) فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ (20) وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ (21) فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ (22) قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ (23)
অর্থাৎ, হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে প্রবেশ কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও, তবে বৃক্ষের পাশে যেয়ো না। তাহলে তোমরা গোনাহগার হয়ে যাবে। অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল যাতে তাদের গোপন অংগসমুহ প্রকাশিত হয়। সে বলল: তোমরা উভয়ে ফেরেশতা কিংবা চিরকাল জান্নাতে বসবাস কারী হয়ে যাবে জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল: অবশ্যই আমি তোমাদের হিতাকাংখী। অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল। অনন্তর, যখন তারা ওই গাছ থেকে আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান সমূহ খুলে গেল এবং তারা বেহেশতের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকতে শুরু করলেন। তাদের পালনকর্তা তাদেরকে ডেকে বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে ওই গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করি নি? আর আমি কি তোমাদেরকে বলে দেই নি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?
তারা উভয়ে বলল: হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা অনুগ্রহ না করেন তাহলে, আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব। (সুরা 'রাফঃ ১৯-২৩)
উপরোক্ত দু'টি ঘটনার দিকে যদি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে আমরা অনেক মৌলিক পার্থক্য দেখতে পাব কুরআন শরীফ বাইবেলের বিপরীত যেখানে দোষারোপ করা হয়েছে আদম হাওয়া(আঃ)উভয়কেই কুরআন শরীফের কোথাও বলা হয় নি যে, হাওয়া (আঃ) আদম (আঃ) কে গাছ থেকে খেতে প্রতারিত করেছেন বা তিনি আদম (আঃ) এর আগেই তা খেয়েছেন।
সুতরাং, কুরআন অনুযায়ী হাওয়া (আঃ) আদম (আঃ) কে প্রতারণা কিংবা বিপথে পরিচালিত করেন নি। আর গর্ভধারণের যন্ত্রণা মায়েদের উপর আল্লাহ তায়ালার শাস্তি নয়। কুরআন শরীফে উল্লেখিত বর্ণণানুযায়ী আল্লাহ তায়ালা কারো অপরাধের কারণে অন্যকে শাস্তি দেন না। অতএব, আদম হাওয়া (আঃ) উভয়েই সমান অপরাধ করে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন আর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
হাওয়া (আঃ)এর অপরাধের উত্তরাধিকার
বাইবেলে বর্ণিত "হাওয়া (আঃ)হযরত আদম (আঃ)কে পথভ্রষ্ট করেছিলেন"বাক্যটি ইহুদী খৃষ্টান ধর্মবিশ্বাসে নারী জাতিকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করেছে ধারণা করা হয় যে, নারী জাতি উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের আদিমাতা হাওয়া (আঃ)এর অপরাধের প্রায়শ্চিত্য ভোগ করে থাকে অতএব, নারীদের উপর নির্ভর করা যাবে না এবং তারা সচ্চরিত্রবান নয়। এছাড়াও বিশ্বাস করা হয় যে, নারী জাতির অপবিত্র হওয়া, গর্ভধারণ করা সন্তান প্রসব করা এগুলো হাওয়া (আঃ) এর অপরাধের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে স্থায়ী শাস্তি। নারীদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে আমাদেরকে ইহুদী খৃষ্টানদের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের দিকে মনোনিবেশ করা আবশ্যক।
তাহলে, প্রথমে বাইবেলের "পুরাতন নিয়ম"(old testament) এর কথায় আসা যাক। আমরা এর কারণ খুজতে গিয়ে দেখতে পাই যে, " মহিলারা মৃত্যুর চেয়েও বেশী তিক্ত। সে হচ্ছে ফাদের মত, তার অন্তর ফিতার মত এবং হাতগুলো বন্ধন। নেককার ব্যক্তি তাদের থেকে মুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে বদকারদেরকে এদের কারণে পাকড়াও করা হবে।" দেখুন! আমি এটাই পেয়েছি।
"এক এক করে আমার মনের প্রশ্নের সমাধান খুজে দেখেছি কিন্তু, আমি তার জবাব খুজে পাই নি। হাজার পুরুষের মধ্যে একজনকে রকম পেয়েছি। কিন্তু, হাজারে একজন মহিলাকেও রকম পাই নি"
ক্যাথলিক বাইবেলে আছে- " এমন কোন পাপ নেই যাকে নারীর পাপের সাথে তুলনা করা যায়। প্রত্যেক পাপের পিছনে আছে কোন না কোন মহিলা আর মহিলাদের কারণেই আমরা সবাই মরে যাব" (এক্সিলেসিয়াস্টিকাসঃ ২৫/১৯,২৪)
এক ইহুদী আলেম বেহেশত থেকে বের হওয়ার কারণে মহিলাদেরকে টা অভিশাপ দেয়া হয়েছে বলে প্রচার করেছেন।
" মহিলাদের উপরে মৃত্যুর আগে টি অভিশাপ রয়েছে। সেগুলো হলঃ-
. অপবিত্র হওয়া
. কুমারিত্বের রক্ত
. গর্ভধারণের কষ্ট
. সন্তান প্রতিপালন সন্তান প্রসবের কষ্ট
. মাথা ঢেকে রাখার বিধান যেন সে শোক পালন করছে।
. তাদের কান ছিদ্র করতে হয়
. তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
এগুলোর পরে রয়েছে মৃত্যু
এখনও আর্থজেক্স ইহুদী পুরুষগণ তাদের প্রার্থনায় বলে থাকে- আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করি এ জন্য যে, আল্লাহ আমাদেরকে নারী করে দুনিয়ায় পাঠান নি। আর নারীরা বলে: আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করি এ জন্যে যে, তিনি যেমন খুশি তেমনি করে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। ৩
ইহুদীদের গ্রন্থে আরেকটি প্রার্থনার উল্লেখ পাওয়া যায় তা হল: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাকে মুর্তিপুজারী করে সৃষ্টি করেন নি। প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে নারী হিসেবে সৃষ্টি করেন নি আর প্রশংসা সে আল্লাহর যিনি আমাদেরকে মুর্খ করে সৃষ্টি করেন নি"।৪
নারীদের প্রতি নেতিবাচক ধারণার কুপ্রভাব ইহুদী ধর্মের চেয়ে খৃষ্টান ধর্মে বেশী প্রকট আকার ধারণ করেছে। হাওয়া (আঃ) এর অপরাধের ব্যাপারটা খৃষ্টান ধর্ম বিশ্বাসে বড় ধরণের প্রভাব ফেলছে। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বিধানের সাথে হাওয়া (আঃ) এর নাফরমানীর ফলাফল। তিনি প্রথম নাফরমানী করেছেন এবং আদম (আঃ) কে তা করার প্ররোচনা দিয়েছেন। ফলে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নামিয়ে দিয়েছেন এবং সে অভিশপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তাদের অপরাধ ক্ষমা করেন নি; বরং তা সমস্ত মানুষের কাছে স্থানান্তরিত হয় প্রত্যেকেই গুনাহের বোঝা নিয়ে দুনিয়ায় আসে। সমস্ত মানুষের উক্ত অপরাধের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে ঈসা (আঃ) কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে(খৃষ্টানদের ধারণা অনুযায়ী ঈসা (আঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু,আসলে ঈসা (আঃ) এখনও সশরীরে জীবিত আছেন-অনুবাদক) তাকে স্রষ্টার পুত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। সমস্ত কারনে হাওয়া (আঃ) তার নিজের, স্বামীর সমস্ত মানুষের প্রথম পাপের জন্য দায়ী এমনকি ঈসা (আঃ) এর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার জন্যেও দায়ী। অন্য কথায় বলতে গেলে সমস্ত মানুষের বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসার কারণ হচ্ছে শুধুমাত্র একজন নারী।
এটা গেল প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ) এর কথা। কিন্তু, তার কন্যাগণের অবস্থা কি? তারাও তার সমান অপরাধী। তাদের সাথে অপরাধীদের সাথে যেমন আচরণ করতে হয় তেমনি আচরণ করতে হবে।
নতুন নিয়মে (new testament) পোল বলেছেন: " মহিলারা চুপিসারে ও নতশীরে শিক্ষা গ্রহণ করবে। আমি কোন মহিলাকে অনুমতি দেব না কোন পুরুষকে শিক্ষাদানের বা পুরুষের উপর কর্তৃত্ব করার; বরং তারা চুপ করে থাকবে(বিনা প্রশ্নে সবকিছু মেনে নেবে) কারণ, আদম (আঃ) প্রথমে পয়দা হয়েছেন তারপর হাওয়া (আঃ) আদম (আঃ) নিজে পথভ্রষ্ট হননি বরং হাওয়া (আঃ) তাকে পথভ্রষ্ঠ করে দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন" ( তিমুথি: / ১১-১৪)
খৃষ্টান আলেম তারতোলিয়ান উক্ত পোপের চেয়ে আরও বেশী কঠোর ছিলেন। তিনি তার খৃষ্টান মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলতেন: " তোমরা কি জান যে তোমরা সবাই একেকজন হাওয়া? তোমাদের উপর আল্লাহ তায়ালা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা আজও বিদ্যমান আছে। পাপ কাজ গুলোও আজ বিদ্যমান। তোমরা হচ্ছ সমস্ত দরজা যা দ্বারা শয়তান প্রবেশ করে। নিষিদ্ধ গাছের পাপাচারের জন্য তোমরাই দায়ী। তোমরাই সর্ব প্রথম পাপ কাজ করেছিলে। যে আদম (আঃ) কে শয়তান পথভ্রষ্ট করতে পারে না তাকে তোমরাই পথভ্রষ্ট করেছ। তোমরা আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষের সম্পর্ককে গুড়িয়ে দিয়েছ। আর তোমাদেরই পাপের কারণেই ইশ্বরের পূত্র ঈসা (আঃ) (খৃষ্টানদের মতে) শুলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন"
আরেক খৃষ্টান পন্ডিত আগাস্টাইন ছিলেন তার পুর্বসুরীদের মতই। তিনি তার বন্ধুকে লিখেছিলেন যে, "স্ত্রী আর মায়েদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা উভয় অবস্থায়ই হাওয়া (আঃ) এর অনুরুপ যিনি আদম (আঃ) কে পথভ্রষ্ঠ করেছিলেন। সুতরাং আমাদের সকলের উচিত তাদের থেকে সতর্ক থাকা। আমাদের বুঝে আসে না নারীদেরকে কেন যে সৃষ্টি করা হয়েছে? সন্তান জন্মদান ছাড়া তাদের দ্বারা আর কোন ফায়দা হয় না। তার কয়েকশতক পর পন্ডিত টমাস আকবীনাস বিশ্বাস করত যে, মহিলাদের দিয়ে কোন লাভ হয় না। তার বক্তব্য হচ্ছে" নারীরা কোন উপকারে আসে না। পক্ষান্তরে, পুরুষেরা নেককার হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের পুত্র সন্তানগণও নেককার হয়। কিন্তু, নারীরা জন্মলগ্ন থেকে তাদের পুর্বেকার নারী হাওয়া (আঃ) এর অপরাধের কারণে কলংক নিয়ে দুনিয়ায় আসে"।
সর্বশেষে, প্রখ্যাত খৃষ্টান পন্ডিত মার্টিন লোথার তিনিও সন্তান জন্ম দান ছাড়া নারীদের দিয়ে আর কোন উপকার হয় বলে মনে করেন না। তিনি বলেন: যখন তারা ক্লান্ত হয়ে যায় বা মারা যায় সেটা কোন ব্যাপারই নয়। সন্তান জন্মের পর তারা তাদেরকে আদর যত্ন করবে এটাই তাদের দায়িত্ব"। হাওয়া (আঃ) আদম (আঃ) কে পথভ্রষ্ঠ করেছেন এ বিশ্বাসের কারণে নারীরা খৃষ্টান ধর্মে তিরস্কারের পাত্রে পরিণত হয়েছে যেমনটি সাফারুত তাকবীনে বর্ণিত হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মবিশ্বাসে হাওয়া (আঃ) ও তার কন্যা সন্তানগণকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়।
এবার আসি কুরআন মাজীদে নারীদের সম্বন্ধে কি বলা হয়েছে তা জেনে নিই। অচিরেই আমরা দেখতে পাব যে, কুরআন ও ইহুদী বা খৃষ্টান ধর্মে বর্ণিত নারীদের চিত্রের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান।
কুরআন শরীফ নিজেই বলছে-
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا (35)
অর্থাৎ, নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী,অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী,সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজাপালন কারী পুরুষ ও রোজা পালনকারী নারী, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থান হেফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক জিকিরকারী পুরুষ ও আল্লাহর অধিক জিকিরকারী নারীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার । (সুরা আহযাবঃ ৩৫)
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (71)
অর্থাৎ, আর ঈমানদার নারী ও ঈমানদার পুরুষ একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেয়। নামাজ প্রতিষ্ঠা (কায়েম) করে, যাকাত আদায় করে আর আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে। অচিরেই আল্লাহ তায়ালা এদের উপর দয়া পরবশ হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী, সুকৌশলী। (সুরা তাওবাহঃ ৭১)
فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ (195)
অর্থাৎ, অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া এই বলে কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করি না। চাই সে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন। তোমরা পরস্পর এক। অতঃপর যারা হিযরত করেছে তাদেরকে নিজেদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং তাদের প্রতি উৎপীড়ন করা হয়েছে আমার পথে এবং যারা লড়াই করেছে ও মৃত্যু বরণ করেছে অবশ্যই আমি তাদের উপর থেকে অকল্যাণকে অপসারন করব আর তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতে যার নিচ দিয়ে নদীসমুহ প্রবাহমান। এই হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিনিময়। আর আল্লাহ তায়ালার নিকট রয়েছে উত্তম বিনিময়। (সুরা আলে ইমরানঃ ১৯৫)
مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُونَ فِيهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ (40)
অর্থাৎ,যে মন্দ কাজ করে সে কেবল তার অনুরুপ প্রতিফল পাবে, আর যে পুরুষ অথবা নারী মু'মিন অবস্থায় সৎকর্ম করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে সেখানে তাদেরকে বেহিসাব রিজিক দেয়া হবে।(সুরা মু'মিনঃ ৪০)
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (97)
অর্থাৎ, যে সৎকর্ম করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের কাজের বিনিময়ে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব। (সূরা নাহলঃ ৯৭)
আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কুরআনে পুরুষ ও নারীর মাঝে কোন বৈষম্য রাখা হয়নি। আল্লাহ তাদের উভয়কে সৃষ্টি করেছেন যেন তারা তার ইবাদত করে, সৎ কাজ করে এবং খারাপ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তাদের উভয়ের কাজের জন্য হিসাব নিবেন। কুরআন শরীফে কোথাও বলা হয় নি যে, নারীরা শয়তানের প্রবেশদ্বার বা তারা জন্ম নিয়েছে প্রতারণার জন্য। এমনও বলা হয় নি যে, পুরুষেরা স্রষ্টার প্রতিকৃতি বরং পুরুষ নারী উভয়ই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। কুরআন শরীফের আয়াত সমূহ পরিস্কার করে বলেছে যে, নারীদের দায়িত্ব শুধুমাত্র সন্তান জন্মদান নয় বরং পুরুষের মতই সমানে সমান তারও দায়িত্ব রয়েছে নেক আমল করার। কুরআন শরীফ বলেনি যে, নেককারিনী নারী পাওয়া দুষ্কর। বরং তার বিপরীতে নারী ও পুরুষদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নেককারিনী নারী মারইয়াম (আঃ) ও ফেরাউনের স্ত্রী প্রমুখদের অনুসরণ করতে। আল্লাহ বলেনঃ
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (11) وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِنْ رُوحِنَا وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ (12)
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা মু'মিনদের জন্য ফেরাউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বলল: হে আমার পালনকর্তা! আপনার নিকট জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মান করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন। আর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এমরানের কন্যা হযরত মারইয়াম (আঃ) এর। যিনি তার সতীত্ব বজায় রেখেছিলেন। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে জীবন ফুকে দিয়েছিলাম এবং তিনি তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিনয় প্রকাশকারীনীদের একজন। (সূরা তাহরীমঃ ১১-১২)
কন্যা সন্তান কি অপমান ডেকে আনে?
আসলে কুরআন ও তাওরাতের মধ্যকার নারী জাতি সংক্রান্ত আলোচনায় মতানৈক্য রয়েছে তার জন্মলগ্ন থেকেই।
উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যে, বাইবেলে রয়েছে নারীরা কন্যা সন্তান জন্ম দিলে সন্তান প্রসবের পরে অপবিত্র থাকে ২ সপ্তাহ। পক্ষান্তরে পুত্র সন্তান জন্ম দিলে অপবিত্র থাকে ৭ দিন বা এক সপ্তাহ। (লেভিটিকাস: ১২/২-৫)
আর ক্যাথলিক বাইবেলে পরিস্কারভাবে বলা আছে যে, "কন্যা সন্তান জন্ম হওয়া একটা ক্ষতি বা লোকসান"।(এক্সিলেসিয়াস্টিকাসঃ ২২/৩) অপরদিকে ঐ সমস্ত পুরুষদেরকে প্রশংসা করেছে " যে তার পুত্র সন্তানকে শিক্ষাদান করে এবং শত্রুরা তাতে ঈর্ষান্বিত হয়"।(এক্সিলেসিয়াস্টিকাসঃ ৩০/৩)
দেখুন! ইহুদী পন্ডিতের কার্যকলাপ। ইহুদী পন্ডিত ইহুদীদেরকে তাগিদ দিচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, সাথে সাথে ছেলে সন্তানদেরকে প্রাধান্য দিচ্ছে " তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান জন্ম দেয়া হবে কল্যাণকর আর কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া হবে অকল্যাণকর"। " সবাই পুত্র সন্তানের জন্মে খুশি হয় কিন্তু, কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তারা চিন্তিত হয়"। " যখন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে তখন তা দুনিয়ায় শান্তি আসার কারণ হয় পক্ষান্তরে কন্যা সন্তানের জন্মে কিছুই হয় না"।৭
কন্যা সন্তান তার পিতামাতার জন্য বোঝা এবং অপমানের কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। " যদি তোমার কন্যা অবাধ্য হয় তাহলে সতর্ক থেক সে তোমার শত্রুদেরকে হাসাবে এবং সে এলাকাবাসীর গল্পের উপভোগ্য হয়ে তোমার জন্য অপমান ডেকে আনবে। (এক্সিলেসিয়াস্টিকাসঃ ৪২/১১)
অবাধ্য নারীর প্রতি তোমার কঠোর হওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, তোমার নির্দেশ অমান্য করবে এবং ভূলের ভিতর দিনাতিপাত করবে। যখন সে তোমার অপমানের কারণ হয় তখন তুমি আশ্চর্য না হয়ে বরং বিচক্ষণতার পরিচয় দাও।(এক্সিলেসিয়াস্টিকাসঃ ২৬/১০-১১)
আর এমনটিই করেছিল জাহেলী যুগের কাফেররা। তারা কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দিত। কুরআন তাদের এ কুকর্মকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছে। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ (58) يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ (59)
অর্থাৎ, আর যখন তাদেরকে কন্যা সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনোযন্ত্রনায় ভুগতে থাকে।
তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের থেকে মুখমন্ডল গোপন করে থাকে। সে ভাবে সে কি অপমান সহ্য করে তাকে দুনিয়ায় থাকতে দেবে নাকি তাকে মাটির নিচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখ! তাদের কৃত ফয়সালা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। (সূরা নাহলঃ ৫৮-৫৯)
যদি কুরআন শরীফে এটাকে নিষিদ্ধ না করা হত তাহলে, এ নিকৃষ্ট কাজটি আজও দুনিয়ায় অব্যাহত থাকত। কুরআন শুধুমাত্র এ কাজটিকে নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয় নি বরং কুরআন পুরুষ ও নারীর ভিতরে কোন পার্থক্যেরও সৃষ্টি করে নি। এটা বাইবেলের বিপরীত। কুরআন শরীফ কন্যা সন্তানের জন্মকে পুত্র সন্তানের মতই আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও বিশেষ দান হিসেবে গণ্য করেছে।
প্রথমতঃ কন্যা সন্তানের জন্মকে কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত বা অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا
وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ (49)
অর্থাৎ, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তায়ালারই। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।(সূরা আশ শুরাঃ ৪৯)
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মদ (সাঃ) কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রচলনকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য কন্যা সন্তানের লালন-পালন ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীকে সুমহান পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ
مَنِ ابْتُلِىَ مِنَ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ
অর্থাৎ, যাকে কোন কন্যা সন্তান দিয়ে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে এবং সে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেছে তারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে পর্দা হয়ে থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)
রাসুল (সাঃ) আরও বলেনঃ
مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ. وَضَمَّ أَصَابِعَهُ.
অর্থাৎ, যে দুইজন কন্যা সন্তানকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন পালন করেছে সে আর আমি কিয়ামতের দিন এভাবে আসব। অতঃপর তিনি তার আঙ্গুলি সমুহকে একত্রিত করলেন।(মুসলিম শরীফ)
নারী শিক্ষা
তাওরাত ও কুরআনে বর্ণিত নারীদের চিত্রের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তা শুধুমাত্র নবজাতক কন্যা সন্তানের বেলায়ই সীমাবদ্ধ নয় বরং এ পার্থক্য জন্মের পরেও চলমান থাকে। এখন আমরা নারী শিক্ষা নিয়ে কুরআন ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তুলনামুলক আলোচনা করব।
ইহুদীদের মৌলিক ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে তাওরাত। তাওরাতে এসেছে- " নারীদের তাওরাত পড়ার কোন অধিকার নেই। জনৈক ইহুদী পন্ডিত এ কথাটাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন: "মহিলারা তাওরাত পড়ার চেয়ে তাওরাতকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা উত্তম।" এ ছাড়াও এসেছে " কোন পুরুষের অধিকার নেই তার কন্যা সন্তানকে তাওরাত শিক্ষাদানের"। ৮
পোল নতুন নিয়মে (new testament) বলেছেন: "তোমাদের স্ত্রীরা গীর্জার ভিতরে চুপ করে থাকবে কেননা, গীর্জার ভিতর কথাবার্তা বলার কোন অধিকার তাদের নেই। এমনকি আইন যা বলবে তাকে বিনা প্রশ্নে নতশীরে মেনে নিবে। তবে, যদি তারা কোন কিছু শিক্ষাগ্রহণ করতে চায় তাহলে, তা শিখবে বাড়ীতে নিজ নিজ স্বামীর কাছ থেকে। কারণ, গীর্জার মধ্যে নারীদের কথা বলা অত্যন্ত জঘন্য কাজ"। (১ করিনথিয়ান্সঃ ১৪/৩৪-৩৫)
নারীদের যদি কথা বলার কোন অনুমতি না থাকে তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? যদি কোন কিছু বাধ্যতামুলক ভাবে মেনে নিতে হয় তাহলে, তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটবে কিভাবে? যদি একমাত্র স্বামীই হয় তার শিক্ষা গ্রহনের অবলম্বন তাহলে কিভাবে তারা বেশী বেশী জ্ঞানার্জন করবে? ন্যায় বিচার করতে গেলে অবশ্যই আমাকে প্রশ্ন করতে হবে যে, ইসলাম কি তার চেয়ে বিপরীত?
কুরআন শরীফে হযরত খাওলা (রাঃ) সংক্রান্ত একটা ঘটনা এসেছে সেখানে উক্ত বিষয় গুলোকে অত্যন্ত সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। তার স্বামী আওস (রাঃ) রাগের বশঃবর্তী হয়ে বলেছিলেন: " তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মত হারাম।" এ কথাটা ইসলাম পূর্ব যুগে আরব সমাজে তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদ হিসেবে ব্যবহৃত হত কিন্তু, স্ত্রীকে অন্যত্র বিবাহ বসা বা স্বামীর বাড়ী ত্যাগ করার অনুমতি ছিল না। হযরত খাওলা (রাঃ) স্বামীর মুখে এ ধরণের কথা শুনে অত্যন্ত চিন্তিত হলেন। সরাসরি চলে গেলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে ঘটনা বর্ণনা করতে। রাসুল (সাঃ) তাকে এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন সমাধান না থাকায় ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু, খাওলা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর সাথে এটা নিয়ে বাদানুবাদ করতে থাকলেন নিজেদের বিবাহ বন্ধন অক্ষুন্ন রাখার মানসে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করে তার সমস্যার সমাধান দিয়ে এ ধরণের প্রথাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এ সময় সূরা মুজাদালাহ নাযিল হয়। আল্লাহ বলেন:
قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ (1)
অর্থাৎ, যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহ তায়ালার দরবারে, আল্লাহ তায়ালা তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেন। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।(সূরা মুজাদালাহ:১)
কুরআন নারীকে অধিকার দেয় স্বয়ং আল্লাহর নবীর(সাঃ) সাথে বাদানুবাদ করার। তাদেরকে চুপ করিয়ে রাখার অধিকার কারো নেই। নারীকে এতেও বাধ্য করা হয়নি যে, তার একমাত্র শিক্ষাগ্রহণস্থল হবে তার স্বামী।
ঋতুবতী নারী আশ পাশের সব কিছুকে নাপাক করে দেয়?
বিশেষভাবে ইহুদী বিধি-বিধান ঋতুবতী মহিলাদেরকে কঠোরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। পুরাতন নিয়ম(old testament) ঋতুবতী মহিলাদেরকে এবং তাদের আশে পাশের সব কিছুকে নাপাক হিসেবে গণ্য করেছে। যে কোন জিনিস সে স্পর্শ করলেই পুরো দিনব্যাপী তা নাপাক থাকবে। যদি কোন মহিলার শরীরে কোন প্রবাহিত রক্ত থাকে যা গোশতের উপর প্রবাহিত হয় তাহলে সে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপবিত্র থাকবে। যে তাকে স্পর্শ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক থাকবে। সে যার উপর বসবে বা শয়ন করবে তা নাপাক বলে গণ্য হবে। যে তার বিছানা স্পর্শ করবে তার শরীরের পোশাক ধৌত করতে হবে, গোসল করতে হবে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক থাকবে। সে যার উপর বসেছে এমন কোন আসবাব পত্রকে স্পর্শ করলেও অনুরুপ তাকে গোসল ও তার পোশাক ধৌত করতে হবে। এমতাবস্থায় সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক থাকবে। (লেভিটিকাসঃ ১৫/১৯-২৩)
এ কারণে মাঝে মাঝে নারীদেরকে কারো সাথে কোন ধরণের আচার-আচরন বা উঠাবসা করতে নিষেধ করা হত। তাদেরকে ঋতুবতী হলে উক্ত সময়টা কাটাতে "নাপাক ভবন" এ পাঠিয়ে দেয়া হত।৯
ইহুদী ধর্ম শাস্ত্র ঋতুবতী মহিলাকে সে কাউকে স্পর্শ না করা সত্বেও হত্যাকারীনী হিসেবে গণ্য করে।
ইহুদী পন্ডিতের মতে, যদি কোন ঋতুবতী মহিলা ঋতুর শুরুতে দুইজন পুরুষের মাঝ দিয়ে হেটে যায় তাহলে, তাদের একজন মারা যাবে। আর যদি ঋতুর শেষের দিকে হয় তাহলে, তাদের উভয়ের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হবে। (bpes.111a)
ঋতুবতী মহিলার স্বামীকেও ইহুদীদের উপাসনালয়ে প্রবেশ করায় বাধা দেয়া হত। কেননা, তার স্ত্রী যে মাটির উপর চলাফেরা করেছে একই মাটির উপর চলাফেরা করার কারণে সেও নাপাক। যে ইহুদী পন্ডিতের স্ত্রী, কন্যা বা মাতা ঋতুবতী থাকে তাকে তাদের উপাসনালয়ে খুতবাহ দিতে দেয়া হত না।১০ এ জন্য এখনও কিছু কিছু ইহুদী মহিলা ঋতুকে "অভিশাপ " নামে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ১১
কিন্তু, ইসলাম কোন ঋতুবতী মহিলাকে বলে না যে, সে তার আশেপাশের জিনিসকে নাপাক করে দেয়। তার উপর অভিশাপ দেয় না। নামাজ ও রোজার মত কয়েকটি ইবাদাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া ব্যতিত সে সম্পূর্ণ সাধারণ জীবন যাপন করে।
সাক্ষ্যদানের অধিকার
আরেকটি বিষয় নারীদের সাক্ষ্যদানের অধিকার। কুরআন ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এটা নিয়ে বেশ মতবিরোধ রয়েছে। কুরআন শরীফ মুমিনদেরকে কোন ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনের সময় দুইজন পুরষ বা একজন পুরুষ ও দুইজন নারীকে সাক্ষী রাখার বিধান রেখেছে। আল্লাহ বলেনঃ
وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ فَإِنْ لَمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَنْ تَضِلَّ إِحْدَاهُمَا فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى
অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্যে দুইজনকে সাক্ষী রাখ। যদি দুই জন পুরুষ না থাকে তাহলে একজন পুরুষ ও দুইজন নারীকে সাক্ষী রাখ যাদের সাক্ষ্য তোমরা পছন্দ কর তাদের মধ্য থেকে; একজন যদি ভূলে যায় তাহলে অন্যজন তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।(সূরা বাকারাঃ ২৮২)
কুরআনের অন্য স্থানে নারীর সাক্ষ্যকে পুরুষের সমান বরং কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর সাক্ষ্য পুরুষের সাক্ষ্যকে বাতিল করে দেয়। যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় কুরআন শরীফ তাকে নির্দেশ দেয় তার অভিযোগের স্বপক্ষে পাচবার কসম করতে। অনুরুপ স্ত্রী যদি তা অস্বীকার করে এবং নিজের মতের স্বপক্ষে পাচবার কসম করে তাহলে সে, অপরাধী সাব্যস্ত হবে না। উপরোক্ত উভয় অবস্থায় তাদের বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَاجَهُمْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ شُهَدَاءُ إِلَّا أَنْفُسُهُمْ فَشَهَادَةُ أَحَدِهِمْ أَرْبَعُ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ إِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ (6) وَالْخَامِسَةُ أَنَّ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَيْهِ إِنْ كَانَ مِنَ الْكَاذِبِينَ (7) وَيَدْرَأُ عَنْهَا الْعَذَابَ أَنْ تَشْهَدَ أَرْبَعَ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ إِنَّهُ لَمِنَ الْكَاذِبِينَ (8) وَالْخَامِسَةَ أَنَّ غَضَبَ اللَّهِ عَلَيْهَا إِنْ كَانَ مِنَ الصَّادِقِينَ (9) وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ حَكِيمٌ (10) إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ مَا اكْتَسَبَ مِنَ الْإِثْمِ وَالَّذِي تَوَلَّى كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ (11)
অর্থাৎ, এবং যারা তাদের স্ত্রীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং তারা নিজেরা ছাড়া তাদের কোন সাক্ষী না থাকে, এরুপ ব্যক্তির সাক্ষ্য হবে- সে আল্লাহর কসম খেয়ে চারবার সাক্ষ্য দেবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী। এবং পঞ্চমবার বলবে, সে যদি মিথ্যাবাদী হয় তবে তার উপর আল্লাহর লা'নত। এবং স্ত্রীর শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যদি সে আল্লাহর কসম খেয়ে চারবার সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্বামী অবশ্যই মিথ্যাবাদী। এবং পঞ্চমবার বলে যে, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয় তবে তার (নিজের) উপর আল্লাহর গযব নেমে আসবে। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে এবং আল্লাহ তওবা কবুলকারী, প্রজ্ঞাময় না হলে কত কিছুই যে হয়ে যেত। যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তার জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি। (সূরা নূরঃ ৬-১১)
আগে ইহুদী সমাজে নারীদেরকে সাক্ষ্যদানের অধিকার দেয়া হত না। ১২
ইহুদী পন্ডিতের মতে- বেহেশত থেকে বের হওয়ার পর নারীদের প্রতি যে সমস্ত অভিশাপ এসেছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য না হওয়া। বর্তমানেও বর্তমানে ইসরাইলে ইহুদীদের ধর্মীয় কোর্টে নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না।১৩ এর কারণ হিসেবে ইহুদী পন্ডিতদের ভাষ্য হচ্ছে ইবরাহীম (আঃ) এর স্ত্রী সারাহ মিথ্যা বলেছিলেন।(জেনেসিসঃ১৬/৯-১৮) অথচ, এ ঘটনাটি কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হওয়া সত্বেও কোথাও বলা হয়নি যে, সারাহ (আঃ) মিথ্যা বলেছিলেন।(সূরা হুদঃ ৬৯-৭৪, সূরা যারিয়াতঃ ২৪-৩০ দ্রষ্টব্য)
ধর্মীয় বা আধুনিক আইনবিশারদ পশ্চিমা খৃষ্টানগণের কেউ গত শতাব্দীর আগ পর্যন্ত কখনো নারীকে সাক্ষ্যদানের অধিকার দেয় নি।১৪ কোন পুরুষ তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ দিলে নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না বাইবেলের নির্দেশনানুযায়ী অভিযুক্ত মহিলা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে অপমানজনকভাবে কোর্টে হাজির হবে।(নং:৫/১১-৩১) কোর্টে যদি সে দোষী সাব্যস্ত হয় তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আর যদি মহিলা নির্দোষ প্রমাণিত হয় তথাপিও অপবাদের কারণে স্বামীর কোন শাস্তি হবে না। যদি কোন পুরুষ কোন মহিলাকে বিবাহ করে দাবী করে যে, সে কুমারী নয়; এ ক্ষেত্রেও নারীর সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয় বরং, মহিলার পরিবারের উপর দায়িত্ব এসে যাবে শহরের বয়স্ক লোকদের সামনে তাকে কুমারী হিসেবে প্রমাণ করা। যদি তারা তাকে কুমারী প্রমাণ করতে না পারে তাহলে, মহিলাকে পিত্রালয়ের সামনে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে। আর যদি তারা তাকে কুমারী প্রমাণ করতে পারে তাহলে, তার স্বামীর উপরে ১০০ রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা করা হবে এবং আজীবনের জন্য তাকে তালাক দেয়ার অধিকার খর্ব করা হবে।
বলা হয়েছে-"যদি কোন পুরুষ কোন মহিলাকে বিবাহ করার পর তার নিকটবর্তী হয়ে তাকে অপছন্দ করে এবং সমাজে তার দুর্নাম করে বলে- আমি একে বিবাহ করে কুমারী হিসেবে পাইনি। তখন তার পিতামাতা তাকে নিয়ে যাবে এবং তাদের বাড়ীর সামনে অবস্থানরত সমাজের বয়স্কদের সামনে তার কুমারিত্বের প্রমাণ হাজির করে বলবে: আমি আমার কন্যাকে এই লোকের সাথে বিবাহ দিয়েছি সে তাকে অপছন্দ করে কুমারী পায়নি বলে সমাজে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। এই দেখুন! এটা তার কুমারিত্বের প্রমাণ বলে বয়স্কদেরকে তার কাপড় দেখাবে। তখন সমাজের বয়স্ক ব্যক্তিরা ঐ ছেলেকে ধরে নিয়ে শাসন করবে এবং ১০০ রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা করে অপবাদের বিনিময় হিসেবে মেয়ের পিতাকে দিবে। আর ঐ মেয়ে হবে তার আজীবনের জন্য স্ত্রী। তালাক দেয়ার কোন অধিকার তার অবশিষ্ট্য থাকবে না। পক্ষান্তরে, যদি কন্যার কুমারিত্ব না পাওয়া যায়; তাহলে, মেয়েকে পিত্রালয়ের সামনে নিয়ে এসে পুরুষেরা তাকে পাথর মেরে হত্যা করবে। কেননা, সে ব্যভিচার করে তার পিত্রালয়কে কলংকৃত করেছে। তাই, এ পাপিষ্টকে ওদের থেকে দূর করে ফেলতে হবে। (ডিউটারনমী: ২২/১৩-২১)
ব্যভিচার
প্রত্যেক ধর্মে ব্যভিচারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাইবেল ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনী উভয়কে মৃত্যুদন্ডের বিধান দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, " যদি কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে ব্যভিচার করে , আর ব্যভিচারীনী তার নিকটাত্বীয় হয় তাহলে, তাদের উভয়কেই মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। (লেভিটিকাসঃ ২০/১০)
ইসলামও ব্যভিচারীদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ বলেনঃ
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (2)
অর্থাৎ, ব্যভিচারিনী নারী, ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ' করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তার রাসুলের প্রতি প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর মুসলমানদের মধ্যকার একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (সূরা নূরঃ ২)
তবে, ব্যভিচারের সংগায় কুরআন ও বাইবেলে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে- ব্যভিচার হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মধ্যকার অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক। পক্ষান্তরে বাইবেলে ব্যভিচারকে শুধুমাত্র বিবাহিতদের মাঝে আবদ্ধ করা হয়েছে। যখন বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা নারীর মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক পাওয়া যাবে তখনই তাদেরকে ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিনী হিসেবে গণ্য করা হবে। " যখন কোন বিবাহিত পুরুষকে অপরের স্ত্রীর সাথে পাওয়া যাবে তখন তাদের উভয়কেই হত্যা করা হবে; এবং বনী ইসরাইল থেকে এসব আপদ দূর করতে হবে। (ডিউটারনমী:২২/২২) "আর কোন পুরুষ যদি তার নিকটাত্মীয় মহিলার সাথে ব্যভিচার করে তাদের উভয়কেই হত্যা করা হবে"। (লেভিটিকাসঃ২০/১০)
বাইবেলের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন বিবাহিত পুরুষ কোন অবিবাহিত মহিলার সাথে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ব্যভিচার বলে ধর্তব্য হবে না। এমতাবস্থায় উক্ত পুরুষ ও নারী ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিনী হিসেবে গণ্য হবে না। বরং ব্যভিচারী হিসেবে গণ্য হবে যখন কোন পুরুষ বিবাহিত হোক বা না হোক নারী বিবাহিতা হয়।
সংক্ষেপে, ব্যভিচার হল বিবাহিতা নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক। বিবাহিত পুরুষ ব্যভিচারী হিসেবে পরিগণিত হবে না।
এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে দু'রকম বিধান কেন?! ইহুদী বিশ্বকোষের মতে নারীরা পুরুষের মালিকানাধিন পণ্যের মত। পুরুষের অধিকার নষ্ট করলে তা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে পক্ষান্তরে, নারীরা পুরুষের মালিকানাধীন পণ্য হওয়ার কারণে তার এ ধরণের কোন অধিকার নেই। ১৫
কোন পুরুষ অপরের স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা আরেক জনের (মহিলার স্বামীর) অধিকারে হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয় তাই, তাকে এ জন্য শাস্তি পেতে হবে। বর্তমানে ইসরাইলে যদি কোন পুরুষ অবিবাহিতা মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ফলে সন্তান হয় তারা বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়। আর যদি বিবাহিতা মহিলার সাথে কোন পুরুষ (বিবাহিত হোক বা না হোক) অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে সন্তান হয়; তাদের সন্তানরা শুধু অবৈধই নয় বরং তারা সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় এবং তাদেরকে অনুরুপ বিতাড়িত বা ধর্ম ত্যাগকারী ছাড়া অন্য কেউ বিবাহ করতে পারে না। এ শাস্তি পরবর্তী দশটি প্রজন্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে যাতে তাদের অপমান কিছুটা হলেও কমে যায়। ১৬
কিন্তু, ইসলাম নারীকে এরুপ মনে করে না বরং কুরআন বলেঃ
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (21)
অর্থাৎ, আর আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন সমুহের মধ্যে এটাও একটা নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রুমঃ ২১)
এটা হচ্ছে কুরআনে বর্ণিত বিবাহের চিত্র যা হবে ভালবাসা, দয়া, সম্প্রীতি ও শান্তির ঠিকানা। এখানে কেউ কারো পণ্য বা দাস নয়। নারী পুরুষ উভয়ের জন্য এখানে নেই কোন দ্বিমুখী বিধান।
মান্নত করা
বাইবেল অনুযায়ী আল্লাহর পথে যে কোন মান্নত পুরন করা আবশ্যক। মান্নত করার পর তা আদায় করতে টালবাহানা করা বাঞ্চনীয় নয়। কিন্তু, নারীদের নিজ ইচ্ছায় মান্নত করা বৈধ নয়; বরং অবিবাহিতা হলে পিতা আর বিবাহিতা হলে স্বামীর অনুমোদন লাগবে। তারা যদি অনুমোদন না দেয় তাহলে তারা মান্নতই করে নাই বলে গণ্য হবে। বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী "কোন পুরুষ যদি আল্লাহর নামে মান্নত করে বা কসম করে তাহলে তার মুখের কথা অনুযায়ী তা পূর্ণ করা আবশ্যক। কিন্তু, মহিলারা যদি আল্লাহর নামে মান্নত করে এবং তার পিতা (পিত্রালয়ে থাকার সময়) তা শুনে চুপ করে থাকে তাহলে, সে মান্নত পূর্ণ করা আবশ্যক হবে। মান্নতের কথা শ্রবনের দিন পিতা যদি নিষেধ করে তাহলে, তার মান্নতসমুহ পুরণ করার কোন অধিকার থাকবে না; বরং তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যদি সে তার স্বামীর জন্য বা অন্য কোন কারণে মান্নত করে থাকে, স্বামী তা শুনে চুপ থাকলেই তা অনুমোদিত হবে; অন্যথায় তা প্রত্যাখ্যাত হবে"।(নং:৩০/২-১৫)
কেন মান্নত করার সময় নারীর কথা গৃহীত হবে না? উত্তর খুবই সংক্ষেপ: সে বিবাহের পুর্বে পিতার মালিকানাধিন (পণ্যের মত) আর বিবাহের পরে স্বামীর। এ মালিকানা পিতাকে নিজ কন্যাকে বিক্রি করার অধিকার পর্যন্ত দিয়ে দেয়। পিতা চাইলে কন্যাকে বিক্রি করতে পারে এ অধিকার তার আছে। আর ইহুদী পন্ডিতরা বলে থাকেন পিতা তার কন্যাকে বিক্রি করতে পারে কিন্তু, মা তার কন্যাকে বিক্রি করতে পারবে না। পিতা তার কন্যাকে বিবাহ দেয়ার জন্য কাউকে প্রস্তাব দিতে পারে কিন্তু, মা সেটা পারে না"।১৭
ইহুদী পন্ডিতরা আরও পরিস্কার করে বলেছেন যে, কোন মহিলা বিবাহ করার পর তার স্বামীর পূর্ণ মালিকানায় স্থানান্তরিত হয়। তাদের মতে- " বিবাহ মহিলাকে তার স্বামীর মালিকানাধিন বানিয়ে দেয় যা কখনো নষ্ট হবার নয়"। তাই কোন মহিলার উচিত নয় তার মালিকের বিনা অনুমতিতে কোন কিছুর প্রতিশ্রুতি বা প্রতিজ্ঞা করা।
ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম বিশ্বাসের এ অবস্থান নারীদের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলেছে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত। পশ্চিমা বিশ্বে বিবাহিতা মহিলারা যাই করতে চেয়েছে তার কোন বৈধতা ছিল না। তাদের স্বামীদের অধিকার ছিল স্ত্রী যে কোন চুক্তি করলে তারা তা বাতিল করতে পারবে। ইহুদী ও খৃষ্টান সমাজে স্ত্রী কোন কিছু করার ব্যাপারে স্বাধীন নয় কেননা, তারা অন্যের মালিকানাধিন পণ্যের মত। পশ্চিমা মহিলারা প্রায় দুই হাজার বছর পর্যন্ত পিতা ও স্বামীর অধিকারে থাকার কারণে পরাধীনতার দুঃসহ যন্ত্রণায় ভূগেছে ।১৮
ইসলামে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার অধিকার আছে স্বেচ্ছায় মান্নত করার। তার ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করার নৈতিক অধিকার কারো নেই। পুরুষ বা নারী যদি কোন কারণে ওয়াদা পুরণে ব্যর্থ হয় তাহলে, তার জন্য কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্য প্রদান করা আবশ্যক। কুরআনে এসেছে-
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (89)
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; বরং পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্য যা তোমরা মজবুত করে রাখ। অতএব, এর কাফফারা হচ্ছে দশজন দরিদ্রকে খাদ্য দান করবে; মধ্যম শ্রেণীর খাদ্য যা তোমরা তোমাদের পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা তাদেরকে বস্ত্র প্রদান করবে কিংবা, একজন ক্রীতদাস মুক্ত করবে। যে ব্যক্তি সামর্থ রাখে না সে তিনদিন রোজা রাখবে। এটা তোমাদের শপথের কাফফারা যখন তোমরা শপথ কর। তোমরা তোমাদের কৃত শপথ সমূহকে রক্ষা কর। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (সূরা মায়েদাহঃ ৮৯)
স্বয়ং রাসূল (সাঃ) এর সামনে মু'মিন পুরুষ ও নারীরা আনুগত্য ও আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে বায়আত বা অঙ্গীকার করত। নারীরা ও ছিল পুরুষের সমানে সমান। (সূরা মুমতাহিনাঃ ১২ দেখুন) এমনকি কোন পুরুষের অধিকার নেই স্ত্রী বা কন্যার পক্ষ থেকে নিজে শপথ করবে বা তারা শপথ করলে তা প্রত্যাখ্যান করবে।
স্ত্রীর অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব
ইসলাম, ইহুদী ও খৃষ্টান তিনটি ধর্মই বিবাহ ও পরিবার গঠনকে গুরুত্ব দিয়েছে স্বামী পরিবারের অভিভাবক এতে সবাই একমত তবে,মতভেদ রয়েছে স্বামীর ক্ষমতার গন্ডিতে। ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম পুরোপুরি ইসলামের বিপরীত। তারা স্বামীকে স্ত্রীর উপর একচ্ছত্র মালিকানার অধিকার দিয়েছে। ইহুদী ধর্মে স্ত্রী যেন স্বামীর কাছে দাসীর সমতুল্য গণ্য হয়।১৯ এ কারণে ব্যভিচারের বিধানে পুরুষ ও নারীর জন্য দু'রকম আইন রয়েছে। স্বামীকে অধিকার দেয়া হয়েছে স্ত্রীর মান্নতের উপর প্রভাব খাটানোর এ বিধান নারীকে সম্পদ ও মালিকানাধীন সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ইহুদী নারী শুধুমাত্র বিবাহের কারণে স্বামীর মালিকানায় চলে আসে এবং স্বামী তার স্ত্রীর সম্পদ ও সম্পত্তিতে প্রভাব খাটায়। ইহুদী পন্ডিতেরা বলে থাকে যে, বিবাহের কারণে স্ত্রী ও তার ধন সম্পদ স্বামীর অধিকারে চলে আসে।২০
এ ছাড়াও এ বিধানের কারণে বিবাহের পরে ধনী স্ত্রী সম্পদহীনা হয়ে পড়ে। ইহুদী ধর্মশাস্ত্রে (তালমুদে) বলা হয়েছে "নারীর কোন সম্পদের মালিক হওয়ার অধিকার নেই। তার মালিকানাধীন সমস্ত সম্পদ স্বামীর বলে গণ্য হবে। স্বামীর মালিকানাধীন সম্পদ তো আছেই এমনকি স্ত্রীর সম্পদও স্বামীর মালিকানায় চলে আসবে। স্ত্রী যা অর্জন করবে বা রাস্তায় কুড়িয়ে পাবে এবং বাড়ীর সমস্ত কিছু এমনকি রুটির টুকরাও স্বামীর অধিকারে। মহিলা কোন লোককে ডেকে মেহমানদারী করলে তা স্বামীর মাল থেকে চুরি হিসেবে গণ্য হবে"।(তালমুদ san 71a, git 62a)
ইহুদী মহিলারা নিজ সম্পদ দিয়ে প্রস্তাবদানকারীকে আকৃষ্ট করে। ইহুদী পরিবারে পিতা তার সম্পদের কিছু অংশ তার মেয়ের জন্য রেখে দেয় যা যৌতুক হিসেবে স্বামীকে দিতে হয়। এ যৌতুকের কারণে ইহুদী পিতার নিকট কন্যা সন্তানের জন্মটা অসস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কন্যাকে ছোটকাল থেকে মানুষ করার দ্বারা তার দায়িত্ব আদায় হয় না; বরং নিজের সম্পদ থেকে কিছু অংশ তার বিবাহের জন্য রেখে দিতে হয়। ফলে ইহুদী সমাজে কন্যা সন্তান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২১
প্রাচীন ইহুদী সমাজে কন্যা সন্তান জন্মের সময়ে পরিবারের সদস্যদের খুশি না হওয়ার কারণ এখান থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়। (দেখুনঃ কন্যা সন্তান কি অপমান ডেকে আনে?) যৌতুক স্বামীর জন্য উপহার হিসেবে দেয়া হয়। স্বামী তার মালিক হলেও তা বিক্রি করার অধিকার তার নেই। এ সম্পদে স্ত্রীরও কোন অধিকার নেই। বিবাহের পর স্ত্রীর উপর কাজকর্ম করা বাধ্যতামূলক তবে, যা রোজগার করবে সবই স্বামীর মালিকানায় চলে যাবে। কেননা সে তার ব্যাপারে দায়িত্বশীল। দু'টি অবস্থা ছাড়া তার মালিকানাধীন সম্পদ সে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার নেই। ১.তালাক দিলে অথবা ২.স্বামীর মৃত্যু।
স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রী মারা গেলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবে। আর স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্বামী মারা গেলে স্ত্রী শুধুমাত্র বিবাহের সময় যৌতুক হিসেবে দেয়া সম্পদের দাবী করতে পারবে; অন্য কোন সম্পদ চাওয়ার অধিকার তার থাকবে না। স্বামী তার নতুন স্ত্রীকে উপহার সামগ্রী দিবে তবে, তাও স্বামীর অধিকারে থাকবে।২২
খৃষ্টান ধর্মও অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ইহুদীদের উক্ত নিয়মাবলী পালন করে আসছিল। কুস্তুনতুনিয়া সাম্রাজ্যের পরবর্তী খৃষ্টান রোমান সাম্রাজ্যের নাগরিক ও ধর্মীয় বিধানাবলীতে স্বামীর জন্য বিবাহের সময় মীরাসের(উত্তরাধিকার) শর্তারোপ করা হত। পরিবারকে তাদের কন্যাদের জন্য উচুমানের যৌতুক নির্ধারণ করে রাখতে হত। ফলশ্রুতিতে পুরুষেরা তড়িঘড়ি করে বিবাহ করত অথচ পরিবারের মহিলারা দেরীতে বিবাহ করতে বাধ্য হত। ২৩
খৃষ্টানদের গীর্জার নিয়মানুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে এবং ব্যভিচারের দোষে অভিযুক্ত না হলে স্ত্রী তার প্রদত্ত যৌতুকের মালামাল দাবী করতে পারে। আর ব্যভিচারের দোষে অভিযুক্ত হলে উক্ত সম্পদের দাবি জরিমানা হিসেবে ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকিবে। ২৪ নাগরিক ও গীর্জার ধর্মীয় বিধানানুযায়ী উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকার নারীদের নিজের অধিকারভূক্ত সম্পত্তিতে কোন অধিকার ছিল না। ১৬৩২ খৃষ্টাব্দে প্রস্তুতকৃত "নারী অধিকার আইন" এ বলা হয়েছিল " স্বামীর মালিকানাধীন সমস্ত সম্পদের মালিক স্বামী নিজেই; আর স্ত্রীর মালিকানাধীন সম্পদের মালিকও তার স্বামী"। ২৫
স্ত্রী বিবাহের পর তার অধিকারভূক্ত সম্পদের মালিকানাই শুধু হারায় না বরং তার নিজের ব্যক্তিত্বও হারায়। স্বেচ্ছায় কোন কাজ করার অধিকারটুকুও সে পায় না। তার যে কোন ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি বা কাজ বাতিল করার অধিকার দেয়া হয়েছে স্বামীকে।এছাড়া যার সাথে নারী চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সেও অপরাধী এবং অপরাধে সহযোগিতাকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা নিজের নামে বা স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চাইতে পারে না। ২৬
আইনানুযায়ী বিবাহিত নারীদের সাথে শিশুদের মত ব্যবহার করতে হবে। সে স্বামীর মালিকানাধীন পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং নিজের মালিকানাধীন সম্পদ, ব্যক্তিত্ব ও বংশ পরিচয় সবকিছু হারিয়ে ফেলবে। ২৭
ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম নারীদেরকে নিকট অতীত পর্যন্ত যে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল ইসলাম সে সকল অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রদান করেছে। মুসলমান নারীদের নিজ স্বামীকে কোন কিছু যৌতুক হিসেবে দিতে হয় না এবং সে সমাজে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে ধর্তব্য হয় না। ইসলাম নারীকে সন্মানিত করেছে তার কোন প্রয়োজন হয় না নিজের অর্থ সম্পদ দেখিয়ে কোন যুবককে (বিবাহের প্রস্তাব দেয়ায়) প্রলুব্ধ করার। বরং স্বামীর জন্য অবশ্য কর্তব্য স্ত্রীকে উপহার তথা মোহরানা পরিশোধ করা। এ মোহরানার সম্পদের পরিপূর্ণ মালিকানা স্ত্রীর নিজের; স্বামী,পরিবারের সদস্য বা অন্য কারো তাতে অধিকার নেই। কিছু কিছু মুসলিম সমাজে এ মোহরানার পরিমান হয়ে থাকে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) ডলারের সমপরিমান পর্যন্ত হীরা।২৮
তালাক হয়ে গেলেও তার সে সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হয় না। স্ত্রী স্বেচ্ছায় না দিলে তার মালিকানাধীন সম্পত্তিতে স্বামীর বিন্দুমাত্রও অধিকার নেই।২৯ আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا (4)
অর্থাৎ,তোমরা খুশি মনে তোমাদের স্ত্রীদেরকে মোহরানা দিয়ে দাও তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে কোন অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সূরা নিসাঃ ৪)
স্ত্রী তার নিজস্ব সম্পদে ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। কেননা, তার নিজের ও তার সন্তানদের জীবন পরিচালনা করার দায়িত্ব স্বামীর উপর ন্যস্ত।৩০
স্ত্রী যতই ধনী হোক না কেন পরিবারের কোন খরচ পরিচালনা করা তার জন্য আবশ্যক নয় তবে যদি সে করে তা ভিন্ন কথা। স্বামী মারা গেলে সে যেমন তার উত্তরাধিকারী সম্পদে অংশীদার হবে তেমনি স্ত্রী মারা গেলেও স্বামী তার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে। ইসলামে বিবাহের পরেও স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা ও বংশগত ঐতিহ্য অবশিষ্ট থাকে।৩১
একবার এক আমেরিকান বিচারক বলেছিলেন " মুসলমান নারীরা সূর্যের মতই স্বাধীন। দশবারও যদি তারা বিবাহ করে তবুও তারা তাদের স্বাধীনতা ও বংশ পরিচয় ধরে রাখতে পারে"।৩২
তালাক
তালাক নিয়ে তিনটি ধর্মে ব্যাপক মতানৈক্য রয়েছে। খৃষ্টান ধর্মে তালাককে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা বাইবেলের নতুন নিয়মের(New Testament) বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোধগম্য হয়। ঈসা (আঃ) এর নামে প্রচার করা হয় যে, তিনি বলেছেন: "আমি বলছি যে তার স্ত্রীকে তালাক দিবে সে যেন তার স্ত্রীর জন্য ব্যভিচারের দরজা উন্মুক্ত করে দিল। আর যে তালাকপ্রাপ্তাকে বিবাহ করল সে যেন ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়ল"। (ম্যাথিউঃ৫/৩২) কিন্তু, এগুলো বাস্তবে বাস্তবায়ন করা হয় না। এগুলো ধার্মিকতার দাবি হওয়া সত্বেও কখনও সম্ভব নয়। বৈবাহিক জীবনের ব্যর্থতার কারণে যদি স্বামী-স্ত্রীর জীবনযাপন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হয় তাহলে, তালাক নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান তাদের কোন উপকারে আসবে না। স্বামী স্ত্রীর জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে গেলে তাদেরকে জোর করে একত্র রাখার কোন অর্থ হয় না। তবে, আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, খৃষ্টান সমাজ আজ তালাককে বৈধতা প্রদান করতে বাধ্য হয়েছে।
পক্ষান্তরে ইহুদীরা কোন কারণ ছাড়াই তালাককে বৈধতা দিয়েছে। পুরাতন নিয়ম (Old Testament) পুরুষকে অধিকার দিয়েছে যে, নিছক পছন্দ-অপছন্দের কারণেই সে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। বলা হয়েছে- " কোন পুরুষ কোন নারীকে বিবাহ করার পর কোন ত্রুটির কারণে তাকে পছন্দ হল না। এরপর সে তালাক লিখে স্ত্রীকে দিয়ে দিল স্ত্রী তার বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার আরেকজনকে বিবাহ করল। সেও স্ত্রী পছন্দসই না হওয়ার কারণে তালাক লিখে স্ত্রীর হাতে দিয়ে দিল। এমতাবস্থায় প্রথম স্বামীর জন্য এ স্ত্রী পুণরায় বৈধ হবে না। কেননা, স্রষ্টার দৃষ্টিতে সে তখন নাপাক। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা যে অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার অতিরিক্ত গ্রহণ করতে পদক্ষেপন করো না"। (ডিউটারনমী:২৪/১-৪)
ইহুদী পন্ডিতরা "অপছন্দ ও দোষ" শব্দ দুটির ব্যাখ্যায় মতবিরোধ করেছেন। ইহুদী ধর্ম শাস্ত্র "তালমুদে" তাদের এ সমস্ত মতবিরোধের বর্ণনা এসেছে। " শামাঈ" গোত্রের মতে স্ত্রী পাপাচারে লিপ্ত না হলে তাকে তালাক দেয়া যাবে না। "হালীল" গোত্রের মতে- যে কোন কারণে এবং যখন খুশি স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে। এমনকি নিছক খাদ্য নষ্ট করে ফেললেও। ইহুদী পন্ডিত "আকীবা" বলেনঃ স্বামীর অধিকার আছে সে বর্তমান স্ত্রীর চেয়ে বেশী সুন্দরী স্ত্রী পেলেও আগের স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে" ।(গিট্টিন ৯০ A-B)
নতুন নিয়ম (New testament) শামাঈদের মতকে গ্রহণ করেছে। অপর দিকে ইহুদী আইনে "হালীল ও আকীবার" মতামতকে গ্রহণ করেছে। আর এ মতই বহুল প্রচলিত।৩৩
এ আইন স্বামীকে অধিকার দেয় কোন কারণ ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার। পক্ষান্তরে, পুরাতন নিয়ম (Old Testament) পুরুষকে অপছন্দ হলে তালাক দেয়ার শুধু বৈধতাই দেয় না; বরং তাকে নির্দেশও দেয়। বলা হয়েছে" খারাপ স্ত্রী তার স্বামীর জন্য অপমান বয়ে আনে এবং সে অপরের ঠাট্টা বিদ্রুপের পাত্র হয়। তার স্ত্রী তাকে সৌভাগ্যবান বানাতে পারে না। নারীরা পাপাচারের কেন্দ্র বিন্দু; তাদের পাপাচারের কারণেই আমাদের সবাইকে মরতে হবে। খারাপ স্ত্রীকে যা খুশি তা বলতে দিও না। যদি সে তা মেনে না নেয় তাহলে তালাক দিয়ে তার থেকে মুক্ত হও"(এক্সিলেসিয়াসটিকাসঃ২৫/২৫)
ইহুদী ধর্ম গ্রন্থ তালমুদে তালাক বৈধ হওয়ার কিছু কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যার কারণে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে " যদি সে রাস্তায় খাওয়া দাওয়া করে। ইহুদী পন্ডিত "মায়ার" বলেন উক্ত স্ত্রীকে তালাক দেয়া আবশ্যক"। (তালমুদঃ গিট্টিন ৮৯ A) যে বন্ধ্যা স্ত্রীর দশ বছর যাবত কোন সন্তান হয় না তাকে বাধ্যতামুলক তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে তালমুদ। ইহুদী পন্ডিত বলেনঃ "কোন নারীর বিবাহের পর দশ বছর পর্যন্ত কোন সন্তান না হলে তাকে যেন স্বামী তালাক দিয়ে দেয়"।(Yeb 64 A)
কিন্তু, ইহুদী আইনে মহিলার কোন অধিকার নেই তালাক চাওয়ার। তবে, আদালতে শক্তিশালী কোন কারণ দেখাতে পারলেই (যা দ্বারা তালাক পাওয়ার দাবিদার সাব্যস্ত হয়) শুধুমাত্র ইহুদী নারীরা তালাক পেতে পারে। যে সমস্ত কারণে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে-
১.স্বামী যদি শারিরীক কোন অংগ-প্রত্যংগের বা ত্বকের কোন রোগে ভুগতে থাকে।
২.স্বামী যদি পরিবারের খাদ্যের বন্দোবস্ত না করতে পারে ইত্যাদি।
এ সময় আদালত তার তালাকের আবেদন গ্রহণ করবে। মহিলা কখনও তালাকের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। বরং শুধুমাত্র স্বামীই তার স্ত্রীকে তালাকের কাগজপত্র দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। এ অবস্থায় আদালত স্বামীকে তালাকে বাধ্য করতে কিছু শাস্তি প্রয়োগ করতে পারে। যেমন-জরিমানা করা, জেলে আটক রাখা, গীর্জায় প্রবেশে বাধা দেয়া ইত্যাদি যাতে সে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় স্বামী তাকে তালাক দিকে অস্বীকৃতি জানালে স্ত্রী সারাজীবন ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে। স্ত্রীকে সারা জীবন না বিবাহিত না তালাক প্রাপ্তা তথা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে হতে পারে। তাদের নিয়ম অনুযায়ী এ অবস্থায় স্বামী অন্য কাউকে বিবাহ করে বা অন্য কোন মহিলার সাথে অবৈধভাবে ঘর সংসার করতে পারে। কেননা, এ অবস্থায় সন্তান হলে তাদের দেশীয় আইনানুযায়ী তা বৈধ হিসেবে গণ্য হয়। স্ত্রী পড়ে থাকবে বিবাহবিহীন কারণ, সে এখনও পুর্ব স্বামীর সথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বসলে সে ব্যভিচারী হিসেবে গণ্য হবে এবং সন্তান হলে তাদের পরবর্তী দশম প্রজন্ম পর্যন্ত সমস্ত সন্তান অবৈধ ঘোষিত হবে। এ স্ত্রীকে বলা হবে "মুকাইইয়াদাহ" বা আবদ্ধ।৩৪
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এরুপ ১০০০ থেকে ১৫০০ পর্যন্ত ইহুদী মহিলা রয়েছে;যারা এভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। ইসরাইলে আছে এরকম ১৬০০০ মহিলা। স্বামীরা তাদেরকে তালাক দেয়ার নাম করে হাজার হাজার ডলার হাতিয়ে নেয়।৩৫
ইসলাম উভয় ধর্মের সমস্যাগুলোর সমাপ্তি ঘোষণা করতে এগিয়ে আসল। ইসলামে বৈবাহিক বন্ধন একটি অত্যন্ত পবিত্র বন্ধন। শক্তিশালী কোন কারণ ছাড়া যা ছিন্ন হবার নয়। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসেও ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে সুষ্ঠু ফয়সালায় বিশ্বাসী। সুষ্ঠু ফয়সালার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে শুধুমাত্র তখনই ইসলাম সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে তালাকের বৈধতা দেয়।
সংক্ষেপে বলতে গেলে ইসলাম তালাকের বৈধতা দেয় কিন্তু, তালাকের পথ রুদ্ধ করতে যা করা দরকার সবকিছু করে। ইসলাম নারী পুরুষ উভয়কেই তালাকের ক্ষমতা দিয়েছে। যা ইহুদীদের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর নারীদের তালাকের সে অধিকার হল-"খোলা" করা।৩৬
তালাক দেয়ার পর স্বামীর কোন অধিকার নেই স্ত্রীকে প্রদত্ত সম্পদ (উপহার ইত্যাদি) ফেরত নেয়ার। তালাকের পর নারীকে প্রদত্ত সম্পদ ফেরত নেয়া সম্বন্ধে আল্লাহ বলেনঃ
وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا (20)
অর্থাৎ, আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থানে অন্য স্ত্রীকে পরিবর্তন করতে চাও , এবং তাদের একজনকে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ দিয়ে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না। তোমরা কি তা অন্যায়ভাবে ও প্রকাশ্য গুনাহর মাধ্যমে গ্রহণ করতে চাও? (সূরা নিসাঃ ২০)
আর যদি স্ত্রী তার বিবাহকে ছিন্ন করতে চায় তাহলে সে তার গৃহীত উপহার সামগ্রী স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে। সম্পদ ফিরিয়ে দেয়াটা ন্যায় সংগত বিনিময় হিসেবে বিবেচিত হবে; কেননা স্বামী চায় তাদের বিবাহ বন্ধন টিকে থাকুক অপরদিকে স্ত্রী তা ছিন্ন করতে চায়। কুরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, স্ত্রী যদি বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে চায়; তখন ছাড়া অন্য কোন সময় স্বামীর জন্য বৈধ হবে না তাকে প্রদত্ত সম্পদ ফিরিয়ে নেয়া। আল্লাহ বলেন:
وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَنْ يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (229)
অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে যা কিছু প্রদান করেছ তা থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কিন্তু, যে ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী উভয়েই ভয় করে যে তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা বজায় রাখতে পারবে না; সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নেয় তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এটা হল আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা। কাজেই এ সীমা অতিক্রম করো না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবে তারাই যালেম। (সূরা বাকারাঃ ২২৯)
রাসূল (সাঃ) এর নিকট একজন মহিলা আসলেন। তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন: আমি আমার বিবাহ বিচ্ছেদ চাই; কিন্তু, তিনি কারণ বর্ণনা করেন নি যে, কি কারণে তিনি তার বিবাহ বিচ্ছেদ চান। তার সমস্যা একটাই যে, তিনি তার সাথে জীবনযাপন করতে ভালোবাসেন না। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ
( أتردين عليه حديقته ) . قالت نعم قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( اقبل الحديقة وطلقها تطليقة )
অর্থাৎ, তুমি কি তাকে বাগান (বিবাহের সময় উপহার স্বরুপ প্রদত্ত) ফেরত দিবে? মহিলা বললেনঃ হ্যা। রাসূল (সাঃ) তার স্বামীকে বললেন: বাগান নিয়ে নাও এবং তাকে একটি তালাক (শুধুমাত্র এক তালাক দিলে আবার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোন সমস্যায় পড়তে হয় না।) দিয়ে দাও। (বুখারী শরীফ)
এছাড়াও শক্তিশালী কারনে মহিলা তালাক দাবী করতে পারে। যেমন-স্বামীর কঠোরতা, বিনা কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করা বা পারিবারিক খরচ না চালানো ইত্যাদি। এ অবস্থায় ইসলামী আদালত মহিলাকে তালাকের ব্যাপারে ফয়সালা দেবে।৩৭
সংক্ষেপে: ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তার কোন তুলনা হয় না। সে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে পারে "খোলা" বিধানের মাধ্যমে বা আদালতে অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে। মুসলিম মহিলাকে কখনো আটকিয়ে রাখা (তালাক না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা) যায় না। ইসলাম আসার পর এ সকল অধিকারবলে ইহুদী নারীরা ইসলামী আদালতে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে তালাক দাবী করত। কিন্তু, ইহুদীরা তাদের তালাককে প্রত্যাখ্যান করে কিছু অধিকার দিয়ে কৌশলে ইসলামী আদালতে যাওয়া থেকে তাদেরকে বিরত রাখল। খৃষ্টান সমাজের ইহুদী মহিলারা এ অধিকার গুলো পেত না; কেননা ওখানকার রোমানীয় আইন ইহুদী আইন থেকে উত্তম ছিল না।৩৮
এখন আমরা দেখব ইসলাম তালাককে কিভাবে গ্রহণ করে? রাসূল (সাঃ) বলেন:
أَبْغَضُ الْحَلاَلِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى الطَّلاَقُ
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধকাজ হচ্ছে তালাক। (আবু দাউদ)
নিছক অপছন্দের কারণে স্বামীর অধিকার নেই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার। অপছন্দ হলেও ইসলাম স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا (19)
অর্থাৎ, স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা এমন জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তায়ালা অনেক কল্যাণ রেখে দিয়েছেন। (সূরা নিসাঃ ১৯)
রাসূল (সাঃ) বলেন:
لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ
অর্থাৎ, কোন মু'মিন যেন কোন মু'মিনা নারীকে উপহাস না করে। যদি তার একটি আচরন পছন্দ না হয় তাহলে,আরেকটি আচরণে হয়ত সে সন্তুষ্ট হবে। (মুসলিম শরীফ)
রাসূল (সাঃ) তাগিদ দিয়ে বলেছেন: যার আচরণ উত্তম সেই পুর্ণ ঈমানদার। তিনি বলেন:
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم لنسائهم خلقا অর্থাৎ, ঐ ব্যক্তি পূর্ণাংগ ঈমানদার যার আচার ব্যবহার উত্তম। আর যার আচার আচরণ স্ত্রীদের কাছে উত্তম সেই উত্তম ব্যক্তি।(তিরমীজী শরীফ)
ইসলাম প্রাক্টিক্যাল ধর্ম তাই সে খেয়াল রাখে যে, কিছু কিছু পরিস্থিতিতে স্বামী স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করা সম্ভব হয় না এবং স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করেও লাভ হয় না; বরং একে অপরের সাথে খারাপ ব্যবহার করে সে সময়ের জন্য স্বামীকে চারটি নসীহত পেশ করেছে। এ সময়কার করণীয় সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন:
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا (34) وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا (35)
অর্থাৎ, পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ তায়ালা একের উপর অন্যকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং তাদেরকে প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায় তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করতে যেওনা। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। যদি তোমরা তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতির আশংকা কর, তবে তারা উভয়ে মীমাংসা চাইলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত কর। আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত। (সূরা নিসাঃ ৩৪-৩৫)
পুরুষের উচিত উপরোক্ত তিনটি নসীহত মেনে চলা।যদি তাতে কোন কাজ না হয় তখন এতে তার পরিবারকে জড়াবে। এ আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, স্ত্রী অবাধ্য না হলে স্বামীর জন্য উচিত হবে না তাকে প্রহার করা। তবে, তাকে সংশোধন করতে গিয়ে জরুরী অবস্থায় প্রহার করা বৈধ। যদি এতে স্ত্রী সংশোধিত হয়ে যায় তাহলে তাকে পুর্বেকার কাজের জন্য তিরস্কার করা উচিত নয় । আর যদি সংশোধন না হয় তাহলে, দ্বিতীয়বার তাকে প্রহার করবে না;বরং উভয়ের পরিবার থেকে সদস্য নিয়ে সালিস বসবে। (প্রহার করলে তা হবে মৃদু আকারে অমানুষিকভাবে যেন না হয় যাতে ব্যাথা হয় এবং তা চেহারাসহ স্পর্শকাতর স্থানে হতে পারবে না।)
বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (সাঃ) মুসলিম পুরুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন অত্যন্ত জরুরী অবস্থা ( অশ্লীল কাজকর্ম বা কথায় জড়িত হওয়া ইত্যাদি)ছাড়া এ পর্যায়ে না আসে। এ অবস্থায়ও শাস্তিটা হবে খুবই সামান্য। নারী যদি এ কাজ থেকে বিরত হয় স্বামীর জন্য তার বিরুদ্ধে পূণরায় একশানে যাওয়া উচিত হবে না। রাসূল (সাঃ) বলেন:
ألا واستوصوا بالنساء خيرا فإنما هن عوان عندكم ليس تملكون منهن شيئا غير ذلك إلا أن يأتين بفاحشة مبينة فإن فعلن فاهجروهن في المضاجع واضربوهن ضربا غير مبرح فإن أطعنكم فلا تبغوا عليهن سبيلا
অর্থাৎ, তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর কেননা, তারা তোমাদের কাছে বন্দী রয়েছে। এটা ব্যতিত তোমাদের আর কোন কিছু করার অধিকার নেই তবে, যদি তারা অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে তাহলে, ভিন্ন কথা। যদি তারা এরুপ করে তাহলে, তাদেরকে বিছানা ত্যাগ কর, আর তাদেরকে মৃদু প্রহার কর যেন তাদের শরীরে কোন ব্যথা (অমানুষিক) না হয়। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন পন্থা অবলম্বন করতে যেও না। (তিরমীজী শরীফ)
রাসূল (সাঃ) কোন কারণ ছাড়া স্ত্রীকে প্রহার করতে নিষেধ করেছেন। একবার রাসূল (সাঃ) এর কাছে একদল মহিলা এসে অভিযোগ করলেন যে, তাদের স্বামীরা তাদেরকে প্রহার করে। রাসূল (সাঃ) ঘোষণা দিলেন: মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরিবার পরিজনের কাছে অনেক নারী এসে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। ঐ সমস্ত পুরুষেরা উত্তম নহে (যারা তাদের স্ত্রীদেরকে প্রহার করে)। (আবু দাউদ)
রাসূল (সাঃ) আরও বলেন: তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের নিকট উত্তম। (তিরমীজী শরীফ)
রাসূল (সাঃ) ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) নাম্নী মহিলাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে লোক স্ত্রীকে প্রহার করে বলে সমাজে পরিচিতি লাভ করেছে তাদেরকে যেন বিবাহ না করে। উক্ত মহিলা নিজেই বর্ণনা করেন: মুয়াবিয়া ও আবু জাহাম আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন: আবু জাহাম! সে তো তার কাধ থেকে লাঠি নামায় না; আর মুয়াবিয়া দরিদ্র যার কোন সম্পদ নেই......(মুসলিম শরীফ)
তালমূদ স্ত্রীকে শিষ্টাচার শিক্ষাদান করতে প্রহার করার অনুমতি দিয়েছে।৩৯
বলা হয়েছে তাকে প্রহার করতে হলে পাপাচারী হওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং শুধুমাত্র গৃহাস্থলীর কাজকর্ম করতে অনীহা প্রকাশ করলেও তাকে প্রহার করা যাবে।তাকে মৃদু নয় বরং তাকে বেত্রাঘাত করা ও খানাপিনা থেকে বিরত রাখারও অনুমতি দিয়েছে। ৪০
কিন্তু, স্বামীর আচরণ খারাপ হওয়ার আশংকা দেখা দিলে কুরআনে বলা হয়েছে:
وإن امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا (128)
অর্থাৎ, কোন মহিলা যদি তার স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ বা এড়িয়ে চলা নীতি অবলম্বনের আশংকা করে তাহলে, তাদের পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করে নেয়াতে কোন দোষ নেই। আর মীমাংসাই উত্তম কাজ। মানুষের আত্মার সামনে লোভ বিদ্যমান রয়েছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং খোদাভীরু হও তবে, জেনে রাখ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সব কাজের খোজ খবর রাখেন। (সূরা নিসা: ১২৮)
এ অবস্থায় নারীকে উপদেশ দেয়া হয়েছে পরস্পরের মাঝে মীমাংসা করে নিতে। (উভয় পরিবারের মধ্যস্থতায় বা তাদের মধ্যস্থতা ব্যতিত) নারীকে স্বামীর বিছানা থেকে পৃথক থাকা বা স্বামীকে প্রহার করার উপদেশ দেয়নি যাতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়ানো যায়। কেননা তা তাদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ককে আরো বেশী ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে। কিছু কিছু আলেম মত প্রকাশ করেছেন যে, এ অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষ থেকে মীমাংসার জন্য আদালত এগিয়ে আসবে। প্রথমে আদালত স্বামীকে সতর্ক করে দেবে অতঃপর স্বামী থেকে স্ত্রীকে দূরে রাখবে এবং সর্বশেষে আদালত স্বামীকে প্রহার করার হুকুম দেবে।৪১
সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় যে, বৈবাহিক সম্পর্ককে অটুট রাখতে স্বামী স্ত্রীকে বিভিন্ন উপদেশ প্রদান করবে। তাদের কোন একজন অপরের প্রতি খারাপ আচরণ করে থাকলে অন্যজন এ উপদেশগুলো কাজে লাগিয়ে তাদের এ পবিত্র বন্ধন অটুট রাখার চেষ্টা করে যাবে। এ চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হলে ইসলাম শেষ চিকিৎসা হিসেবে হৃদ্যতার সাথে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনুমতি দেয়।
মায়েরা
বাইবেলের পুরাতন নিয়মের (Old Testament) অনেক স্থানে পিতামাতার সাথে সৎব্যবহারের নির্দেশ এবং অসৎব্যবহার সম্বন্ধে সতর্কবাণী এসেছে। বলা হয়েছে-"কোন মানুষ তার পিতামাতাকে গালি দিলে তাকে হত্যা করা হবে"। (লেভিটিকাসঃ ২০/৯) "জ্ঞানী পুত্র তার পিতাকে উৎফুল্ল করে আর মুর্খ ব্যক্তি মাতাকে অপমানিত করে"।(প্রভার্বস:১৫/২০) কিছু কিছু অধ্যায়ে বলা হয়েছে শুধুমাত্র পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করতে। "জ্ঞানী পুত্র পিতার শাসনকে মেনে নেবে আর উপহাসকারী কারো ধমকের উপেক্ষা করে না"।(প্রভার্বস:১৩/১) কিন্তু, কোথাও আলাদাভাবে মাতাকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার দাবিদার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। এমনকি যে মাতা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ,প্রসব ও দুধ খাইয়ে লালন পালন করেছেন কোথাও সে মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়নি। মাতা তার সন্তানদের থেকে উত্তরাধিকার পায় না অথচ পিতা তার উত্তরাধিকার হয়।৪২
অন্যদিকে বাইবেলের নতুন নিয়মে (New Testament) মাকে কোন মর্যাদা দেয়া হয় নি। বরং, মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারকে স্রষ্টার পথে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন নিয়ম অনুযাযী কোন খৃষ্টান যীশুর অনুসারী বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ না সে তার জন্মদাত্রী মাকে অপছন্দ করে। যীশুর নামে প্রচারিত আরেকটি কথা পাওয়া যায় " কোন মানুষ যতক্ষন না তার পিতা, মাতা,স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ভাইবোনদেরকে অপছন্দ করবে ততক্ষন পর্যন্ত সে আমার ছাত্র বলে গণ্য হবে না"। (লুকঃ১৪/২৬) নতুন নিয়মের আরেকটি অধ্যায় রয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে, যীশু তার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। উদাহরণ স্বরুপ যখন তিনি তার ছাত্রদেরকে শিক্ষা দিতেন তখন তার মা তাকে খোজ করলে তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। "তখন তার ভাতৃবর্গ ও মা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকত। একদল ছাত্র যারা তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন তারা বললেন: বাইরে আপনার মা ও ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তারা আপনাকে ডাকছে। তিনি তাদেরকে বলতেন কে আমার মা বা ভাই? তার পর উপবিষ্টদেরকে বলতেন: আমার মা ও ভ্রাতৃবর্গ! যারা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করবে তারাই আমার ভাই, বোন বা মা"। (মার্কসঃ৩/৩১-৩৫)
অথবা, কেউ বলল: ধর্মীয় শিক্ষা পরিবার পরিজন থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু,যীশু তার মায়ের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তার শিক্ষাদান কার্য অব্যাহত রাখলেন। অপর একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে- মায়ের মর্যাদা অনেক তিনি সন্তানকে প্রসব করেছেন, তাকে লালন-পালন করেছেন মর্মে একজনের কথায় যীশু একমত পোষণ করেন নি। " যখন তিনি কথা বলছিলেন তখন সমবেত জনতার মধ্য থেকে একজন মহিলা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন যে, কতইনা সৌভাগ্য সে পেটের যে পেট আপনাকে ধারণ করেছে কতই না সৌভাগ্য ঐ স্তনদ্বয়ের যার থেকে আপনি দুগ্ধ পান করেছেন। কিন্তু, তিনি বললেন: কতই না সৌভাগ্য তাদের যারা আল্লাহর কালাম শুনেছে ও তা আত্মস্থ করেছে"।(লুকঃ১১/২৭-২৮)
কুমারী মারইয়াম (আঃ) এর মত সন্মানিতা নারীর সাথে যদি সন্মানিত ব্যক্তি যীশু এ রকম ব্যবহার করেন তাহলে, সাধারণ মা ও সাধারণ পুত্রের অবস্থা কি হতে পারে?
কিন্তু, ইসলামে মায়েদেরকে যে সন্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়েছে তার কোন তুলনা হয় না। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালা'র পরেই পিতামাতার সাথে সৎ ব্যবহার করার নির্দেশ প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন:
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23) وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (24)
অর্থাৎ, এবং তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সৎ ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে "উফ" শব্দটিও বলো না,তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারমূলক কথা বল। তাদের সামনে মাথা অবনমিত হও এবং বল- হে আমার পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশব কালে লালন পালন করেছেন। (সূরা বনী ইসরাইলঃ ২৩-২৪)
এ ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন অংশে মায়েদের সুউচ্চ মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ (14)
অর্থাৎ, আর আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তাদের পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতে। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। আমি নির্দেশ প্রদান করেছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। (সূরা লোক্বমানঃ১৪)
রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইসলামে মায়ের মর্যাদাকে তুলে ধরেছেন।
হাদীসে এসেছে-
جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال يا رسول الله من أحق الناس بحسن صحابتي ؟ قال ( أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أبوك )
অর্থাৎ, রাসূল (সাঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার ভাল আচরণ পাওয়ার সর্বাপেক্ষা বেশী হকদার কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। তিনি পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন তারপর কে? রাসুল (সাঃ) জবাবে বললেনঃ তোমার মা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন: তারপর কে? রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন: তোমার মা। আগন্তুক চতুর্থবার জিজ্ঞাসা করলেন: তারপর কে? রাসূল (সাঃ) চতুর্থবারে বললেন: তোমার পিতা। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
মুসলমানরা তাদের মায়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকে। সব সময়ই মুসলমান ছেলে-মেয়ে ও মায়েদের মধ্যকার মধুর সম্পর্ক এবং পিতামাতার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা দেখে পশ্চিমারা রীতিমত অবাক হয়ে যায়।
উত্তরাধীকার সম্পদে নারী
নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর পর তাদের সম্পদে নারীদের পাপ্য সম্বন্ধে কুরআন ও বাইবেলে মতবিরোধ রয়েছে। ইহুদী পন্ডিত এপস্টাইন নারীদের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে বলেন: "বাইবেল নাযিল হওয়ার পর থেকেই নিকটাত্মীয়দের সম্পদে মহিলা তথা স্ত্রী ও কন্যার কোন অধিকার ছিল না। মহিলা নিজেও উত্তরাধিকারী সম্পদের অংশ বলে বিবেচিত হত তবে, তার কোন অধিকার ছিল ঐ সম্পদে। অপরদিকে মুসায়ী (মূসা আ:) শরীয়তে অন্য কোন সন্তান না থাকলে কন্যাদেরকে ওয়ারিস গণ্য করা হত। কিন্তু, স্ত্রী এ সম্পদ থেকে কিছুই পেত না"।৪৪
কেন মহিলা উত্তরাধিকারী সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হবে? এর জবাবে এপস্টাইন বলেন: সে উত্তরাধিকার সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা, সে বিবাহের পূর্বে পিতার ও বিবাহের পরে স্বামীর মালিকানাধীন সম্পদ (পণ্য) হিসেবে গণ্য হয়"। ৪৫
বাইবেলে উত্তরাধিকারের আইন লিপিবদ্ধ আছে। (নং ২৭/১-১১) স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর কোন অধিকার দেয়া হয় নি। অথচ, স্ত্রী মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার রয়েছে স্বামীর। এমনকি পুত্রদের আগেই স্বামীর অধিকার দেয়া হয়েছে। অন্য কোন সন্তান না থাকলে কন্যাগণ ওয়ারিস হবে। মায়েরও কোন অধিকার দেয়া হয় নি উত্তরাধিকারী সম্পদে। মৃত ব্যক্তির যদি কোন সন্তান থাকে তাহলে বিধবা ও তার কন্যাগণ তাদের দয়ার মুখাপেক্ষী থাকবে। এজন্য ইহুদী সমাজে দেখা যায়- কন্যা সন্তান ও বিধবাগণ হয় সমাজের দরিদ্র শ্রেণী। খৃষ্টান সমাজ বহুকাল যাবত উপরের বিধানই পালন করে এসেছে। রাষ্ট্রীয় আইন ও গীর্জার ধর্মীয় আইন নারীদেরকে তাদের পিতার সম্পদে ওয়ারিস হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছিল। স্ত্রীর ও কোন অধিকার ছিল না স্বামীর সম্পদে । বিগত শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত এ ধরণের কঠোর আইন প্রচলিত ছিল।৪৬
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবরা নারীদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করত। ইসলাম এ ধরণের সমস্ত অত্যাচারী আইন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নারীদেরকে তাদের নিকটাত্মীয়ের পরিত্যক্ত সম্পদে অংশ নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ বলেন:
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا (7)
অর্থাৎ, পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পদে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক বা বেশী। এ অংশ নির্ধারিত। (সূরা নিসা:৭)
ইউরোপীয়রা এগুলো শেখার কয়েকশত বছর আগে থেকেই মুসলিম মা, স্ত্রী,কন্যা ও বোনেরা তাদের আত্মীয় স্বজনের সম্পত্তিতে অধিকার ভোগ করে আসছে। কুরআন শরীফে ওয়ারিসদের অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বিস্তারিত ভাবে। (দেখুন- সূরা নিসাঃ ৭, ১১, ১২ ও ১৭৬ নং আয়াত) কয়েকটা অবস্থা ব্যতিত নারীর সে অংশ হচ্ছে পুরুষের অর্ধেক। ব্যতিক্রম অবস্থার মধ্যে একটি হচ্ছে পিতা, মাতার সমান অংশ পাবে। আমরা এ কথাটি বললে মনে হবে যেন ইসলাম এটা যুলুম করেছে। অথচ, আমরা যদি তার কারণ খুজতে যাই তাহলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে পুরুষের অর্থনৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে। (দেখুন-স্ত্রীর অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব অধ্যায়)
স্বামী তার স্ত্রীকে যে উপহার দিবে তালাক দিলেও সে উপহারের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে স্ত্রীর। স্ত্রীর জন্য স্বামীকে উপহার দেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ইসলামে সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীর খরচ বহন করা স্বামীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। স্ত্রীর উপর এ সমস্ত খরচের কোন দায়-দায়িত্ব নেয়। তবে, নিজে করতে চাইলে আলাদা কথা। তার মালিকানাধীন সমস্ত সম্পদে রয়েছে তার একচ্ছত্র মালিকানা। ইসলাম বিবাহকে পবিত্র বন্ধন হিসেবে আখ্যা দিয়ে যুবকদেরকে বিবাহের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে এবং তালাকের প্রতি বিতৃষ্ণা সঞ্চার করে দিয়েছে। বৈরাগ্যকে ইসলামে উৎসাহ প্রদান করা হয়নি। ফলে, মুসলিম সমাজে বিবাহকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে এবং সে সমাজে বৈরাগী খুব কমই দেখা যায়। নারীদের চেয়ে পুরুষের অর্থনৈতিক দায়িত্ব অনেক বেশী। তাই, সমস্ত মতবিরোধ থেকে বেরিয়ে এসে উত্তরাধিকারী সম্পদের বিধানে সমতা স্থাপন করা হয়েছে। এক ইংরেজ মুসলিম মহিলা বলেছিলেন: "ইসলাম শুধু নারীর প্রতি ইনসাফ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাকে সন্মানের আসনে বসিয়েছে"।৪৮
বিধবার সমস্যা সংকুল জীবন
বাইবেলের পুরাতন নিয়ম(Old Testament) অনুযায়ী মহিলাকে উত্তরাধিকারী সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার কারণে ইহুদী সমাজে বিধবারা থাকে অত্যন্ত দরিদ্র ও অসহায়। স্বামীর আত্মীয় স্বজন তার খরচাদির ব্যবস্থা করলেও তার নিজের হাতে কোন শক্তি নেই তাদেরকে খরচে বাধ্য করার। বরং, তাদের অনুগ্রহের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। এজন্য ইসরাইলে বিধবাগণ সমাজে সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে। (ইশইয়াঃ৫৪/৪)
কিন্তু, বিধবাদের সমস্যার এখানেই শেষ নয়; বরং, বাইবেলে (জেনেসিসঃ ৩৮) এসেছে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী সন্তানহীনা হলে স্বামীর ভাইয়ের সাথে বিবাহ বসবে যদিও সে বিবাহিত হয়। উদ্দেশ্য হল তার ভাইয়ের যেন সন্তান হয় এবং তার নাম মরার পরেও সমাজে বেচে থাকে।" ইয়াহুযা আওনানকে বললেন: তোমার ভাইয়ের স্ত্রীর কাছে যাও, তাকে বিবাহ কর এবং তোমার ভাইয়ের বংশকে রক্ষা কর"। (জেনেসিসঃ৩৮/৮) বিধবা নারীকে এ বিবাহে দ্বিমত করার কোন অধিকার দেয়া হয়নি। তাকে শুধুমাত্র মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারী সম্পদের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। তার দায়িত্ব শুধু তার মৃত স্বামীর বংশ রক্ষা করা। আজও ইসরাইলে এ প্রথাই চালু রয়েছে।৪৮
বিধবা মহিলা তার স্বামীর ভাইয়ের অংশের উত্তরাধিকারী সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। স্বামীর ভাই যদি ছোট হয় তাহলে তার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী অপেক্ষা করবে। ভাই যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে শুধু তখনই সে স্বাধীন বলে গণ্য হবে এবং যাকে খুশি বিবাহ করতে পারবে। এ জন্যই স্বামীর ভাই কর্তৃক বিধবার স্বাধীনতা খর্ব করার রীতি ব্যাপকতা লাভ করেছে।
ইসলাম পুর্ব যুগে প্রায় এ ধরণেরই প্রথা চালু ছিল। তখন বিধবারা স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হত এবং তার পুরুষ আত্মীয় স্বজন তাতে অংশীদার হত। তখন আরো একটি প্রচলন ছিল, মৃত ব্যক্তির জেষ্ঠপুত্র তার সৎ মা'কে বিবাহ করত। কুরআন শরীফে এ সকল প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَلَا تَنْكِحُوا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُمْ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاءَ سَبِيلًا (22)
অর্থাৎ, তোমাদের পিতাগণ যে মহিলাদেরকে বিবাহ করেছেন তোমরা তাদেরকে বিবাহ করো না। তবে যা বিগত হয়ে গেছে তা আলাদা। নিশ্চয় এটা অশ্লীল ও গযবের কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ। (সূরা নিসা: ২২)
বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা মহিলাগণ ইহুদী ধর্মে ঘৃণার পাত্র। গীর্জার ধর্মীয় পন্ডিতের জন্য বৈধ নয় কোন বিধবা, তালাক প্রাপ্তা বা ব্যভিচারী নারীকে বিবাহ করা। " ধর্মীয় পন্ডিত কুমারী নারীকে বিবাহ করবে। বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা বা ব্যভিচারী নারীকে বিবাহ করবে না; বরং, নিজের জাতির কুমারীকে বিবাহ করবে। তার, বংশকে কালিমালিপ্ত করবে না কেননা আমি পালনকর্তা পবিত্রকারী। (লেভিটিকাসঃ২১/১৩-১৫)
বর্তমানে ইসরাইলে পোত্তলিক আমলের বড় বড় জাদুকরদের বংশ বর্তমান রয়েছে। তাদেরও অধিকার নেই কোন বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা বা ব্যভিচারী নারীকে বিবাহ করার।৪৯
ইহুদী ধর্মে কোন মহিলা তিনবার বিবাহ করার পর আবার বিধবা হলে (তিনজন স্বামীই যদি মারা যায়) তাকে "হত্যাকারীনী" হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। তাকে আবার পুনরায় বিবাহ করার অধিকার দেয়া হয়না।৫০
কিন্তু, কুরআন শরীফে এগুলোর কিছুই নেই। বরং মুসলিম বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারী যাকে খুশি তাকেই বিবাহ করতে পারে। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তাকে কোরআনের কোথাও ঘৃণার চোখে দেখা হয় নি।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এসেছে-
وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِتَعْتَدُوا وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ وَلَا تَتَّخِذُوا آيَاتِ اللَّهِ هُزُوًا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (231)
আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও (এক বা দুই তালাক), অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়,তখন তোমরা নিয়মানুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও অথবা সহানুভুতির সাথে মুক্ত করে দাও। তোমরা তাদেরকে জালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না।যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে। আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং তাও স্মরণ কর, যে কিতাব ও জ্ঞানের কথা তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে; যার দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়েই জ্ঞানময়। (সূরা বাকারাঃ ২৩১)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (234)
অর্থাৎ, আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যু বরণ করবে এবং তাদের নিজেদের স্ত্রীদেরকে রেখে যাবে, সে স্ত্রীদের কর্তব্য হল নিজেরা চারমাস দশদিন পর্যন্ত অপেক্ষা(ঈদ্দত পালন) করবে। তারপর যখন ইদ্দত পুর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতিসংগত ব্যবস্থা নিলে কোন পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ২৩৪)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِأَزْوَاجِهِمْ مَتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ مِنْ مَعْرُوفٍ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (240)
অর্থাৎ, আর যখন তোমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরন করবে তখন তাদের স্ত্রীদের ঘর থেকে বের না করে এক বছর পর্যন্ত তাদের খরচের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যাবে। অতঃপর, যদি স্ত্রীরা নিজে থেকেই বের হয়ে যায়, তাহলে সে যদি নিজের ব্যাপারে কোন উত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবে তাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারাঃ ২৪০)
বহুবিবাহ
এবার আমরা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে আলোচনা করব তা হল বহুবিবাহ। বহুবিবাহ একটি পুরাতন রীতি যা বহু সম্প্রদায়েই পাওয়া যেত।বাইবেলেও বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে (OldTestament) ইহুদী পন্ডিতদের লেখনীতে সর্বদা বহুবিবাহের বৈধতার কথা লক্ষ করা যায় বলা হয় যে, হযরত সুলায়মান (আঃ)এর নিকট ৭০০ স্ত্রী ৩০০ দাসী ছিল(১, কিংসঃ১১/৩) আর দাউদ (আঃ) এরও বেশ কিছু স্ত্রী দাসী ছিল। (, সামুয়েলঃ৫/১৩)
পুরাতন নিয়মে (OldTestament) পিতার উত্তরাধিকারী সম্পদে পুত্র এবং একাধিক স্ত্রীদের অংশ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে(ডিউটারনমী:২২/)তবে, শুধুমাত্র স্ত্রীর বোনকে বিবাহ করা হারাম করা হয়েছে(লেভিটিকাসঃ১৮/১৮) ইহুদী ধর্মগ্রন্থ তালমুদে বলা হয়েছে: "স্ত্রীদের সংখ্যা যেন কোন ক্রমেই চারের বেশী না হয়"।৫১
ইউরোপের ইহুদীগন ষষ্ঠদশ শতাব্দী পর্যন্ত বহুবিবাহের প্রথা চালু রেখেছিল। আর প্রাচ্যের ইহুদীগন ইসরাইলে(যেখানে বিহুবিবাহ নিষিদ্ধ) আসার আগ পর্যন্ত এটা অব্যাহত রেখেছিল। তবে, তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বহুবিবাহ এখনও বৈধ।৫২
বাইবেলের নতুন নিয়মে (New Testament) ব্যাপারে কি বলা হয়েছে? আসুন দেখে নেয়া যাক। "ইউহান্না হিলমান" তার কিতাবের "বহুবিবাহ নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা" শিরোনামে লিখেছেন-"বহুবিবাহ সম্বন্ধে নতুন নিয়মে (New Testament) কোন নির্দেশও দেয়া হয়নি আবার নিষিদ্ধও করা হয় নি"।৫৩
তৎকালীন ইহুদী সমাজে বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন থাকা সত্বেও ঈসা (আঃ) বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি। "ইউহান্না হিলমান" আসল ব্যাপারটা প্রকাশ করে দিয়ে বলেছেন: রোমের গীর্জা থেকেই বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইউনানী-রোমানীয় কৃষ্টি কালচারের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। এ কৃষ্টি-কালচার একজন মাত্র স্ত্রী রাখার বৈধতা দেয় এবং ব্যভিচারকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি তার কথার স্বপক্ষে পন্ডিত এজেস্টাইনের কথা তুলে ধরেন। "বর্তমানে আমাদের উচিত রোমানীয় সভ্যতাকে অনুসরণ করা সুতরাং দ্বিতীয় বিবাহকে আর বৈধতা দেয়া হবে না"।৫৪
আফ্রিকার গীর্জাগুলোর পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয় যে, ইউরোপীয় খৃষ্টানরা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে রোমানীয় সভ্যতার সাথে তাল মেলানোর জন্য ধর্মের কোন কারণে নয়।
কুরআন শরীফও বহুবিবাহের স্বীকৃতি দেয় তবে, তা শর্ত সাপেক্ষে। আল্লাহ বলেন:
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَى فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ذَلِكَ أَدْنَى أَلَّا تَعُولُوا (3)
অর্থাৎ, যদি তোমরা এতিমদের সাথে ন্যায় বিচার করতে পারবে না বলে আশংকা কর তাহলে, মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা দুই, তিন বা চারটি পর্যন্ত বিবাহ করে নাও। আর যদি আশংকা কর যে, তাদের সাথে ন্যায় সংগত আচরণ করতে পারবে না তবে, একটিই বা তোমাদের অধিকার ভূক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে।(সূরা নিসা:৩)
কুরআন বাইবেলের বিপরীত। কুরআন বহুবিবাহের সীমা নির্ধারন করে দিয়েছে চারটি পর্যন্ত ন্যায়বিচারের শর্তে। কুরআন শরীফ মুসলমানদেরকে বহুবিবাহ করতে উৎসাহ দেয় নাই; বরং, অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু, কেন? কেন বহুবিবাহের অনুমতি দিয়েছে? উত্তর ছোট্ট। তাহল-কিছু কিছু সময় ও স্থানে এগুলো সামাজিক কারণেই জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। আগের আয়াতেও বলা হয়েছে এতীম ও বিধবাদের কারণে বহুবিবাহকে বৈধ করা হয়েছে। আর ইসলাম সর্বযুগের সর্বকালের সর্বস্থানের জন্য অত্যাধুনিক।
অধিকাংশ সমাজে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশী থাকে। আমেরিকাতে নারীর সংখ্যা রয়েছে পুরুষের চেয়ে কমপক্ষে আশি লক্ষ বেশী। গিনিয়াতে প্রতি ১০০ পুরুষের জন্য রয়েছে ১২২ জন মহিলা। তানজানিয়ায় প্রতি ১০০ জন মহিলার জন্য রয়েছে ৯৫.১০ জন পুরুষ।৫৫
এ সমস্যা সমাধানে সমাজের কি করা উচিত? এর অনেকগুলো সমাধান আছে। কেউ কেউ বলে: তারা অবিবাহিত থেকে যাবে। অন্যরা বলেন: জীবন্ত কবর দিতে হবে। (বর্তমান সমাজেও কিছু কিছু সমাজে এর প্রচলন লক্ষ করা যায়।) কোন কোন সমাজ জিনা-ব্যভিচারকে বৈধতা দেয় ইত্যাদি। তবে, আফ্রিকার অধিকাংশ সমাজে বহুবিবাহের বৈধতা রয়েছে। পশ্চিমারা অনেকেই মনে করেন যে, বহুবিবাহ নারীর জন্য অপমানকর। উদাহরণ স্বরুপ-কোন কোন সমাজের মেয়েরা বহুবিবাহকে সমর্থন করে থাকেন এতে পশ্চিমারা রীতিমত আশ্চর্য হয়। আফ্রিকার অধিকাংশ যুবতী নারী তার বিবাহের জন্য বিবাহিত পুরুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কেননা, তারা বুঝতে পারেন যে, উক্ত স্বামী তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম। প্রচুর সংখ্যক আফ্রিকান মহিলা নিঃসংগতা কাটাতে স্বামীদেরকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে উৎসাহ প্রদান করে থাকেন।৫৬
নাইজেরিয়ায় ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়স্ক ৬০০০ মহিলার মধ্যে প্রায় ৬০% তার স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে বাধা দেননা। আর ২৩% মহিলা এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন। কেনিয়ার ৭৬% মহিলা বহুবিবাহকে প্রত্যাখ্যান করেননা। কেনিয়ার গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেক ২৭ জন মহিলার মধ্যকার ২৫ জন মহিলা বহুবিবাহকে প্রাধান্য দেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে-তারা মনে করে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করলে বাড়ীতে তাদের উপর কাজের চাপ কমে যাবে।৫৭
আফ্রিকার অধিকাংশ সমাজেই বহুবিবাহ বৈধ রয়েছে। এমনকি "প্রটেস্টেন্ট গীর্জা"ও এটাকে বৈধতা দেয়। উচ্চপদস্থ এক ইংরেজ খৃষ্টানযাজক কেনিয়াতে বলেছেন: যদিও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার দ্বারা স্বামী স্ত্রীর মাঝে মহব্বত পয়দা হয়; তবে, গীর্জা চিন্তা করে যে, অনেক সমাজে মহিলারা বহুবিবাহকে সাদরে গ্রহণ করছে। এবং এ বহুবিবাহ প্রথা খৃষ্টান ধর্মবিরোধী নয়"।৫৮
"আফ্রিকায় বহুবিবাহ" প্রথার উপর গবেষণা করে খৃষ্টান পাদ্রী " ডেভিড জেতারী" বলেছেন: তিনি তালাক ও পুনর্বিবাহের চেয়ে তালাকপ্রাপ্তা নারী ও শিশুদের দিকে লক্ষ্য করে বহুবিবাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।৫৯
আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক মহিলাকে চিনি যারা দীর্ঘদিন থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থান করছেন। তারা বহুবিবাহবিরোধী নন। তাদের মধ্যকার একজন যিনি আমেরিকায় বসবাস করতেন তিনি তার স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে সন্তান পালনে তাকে বেগ পেতে না হয়। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা খুব বেশী দেখা যায় যুদ্ধের সময়। আমেরিকার হিন্দু সপ্রদায়ের লোকেরা এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশী ভূগত। এ সম্প্রদায় সমুহের মহিলারা অবৈধ সম্পর্কের চেয়ে বহুবিবাহকেই বেশী অগ্রধিকার দিত। অপরদিকে ইউরোপের উপনিবেশবাদীরা অন্য কোন বিকল্প রাস্তা দেখিয়ে না দিয়েই "অসভ্য" আখ্যায়িত করে বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।৬০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীতে পুরুষের চেয়ে মহিলা ছিল ৭৩,০০,০০০ বেশী তন্মধ্যে ৩৩ লক্ষ বিধবা। সেখানে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১০০ জন পুরুষ ছিল সমবয়সী ১৭৬ জন মহিলার বিপরীতে।৬১
সে সময় তাদের মধ্যকার অনেকেই পুরুষের প্রতি শুধু জীবনসংগী হিসেবে নয়; বরং, অভাবের তাড়নায় ভরনপোষণকারী হিসেবেও তাদের মুখাপেক্ষী ছিল। বিজয়ী সেনারা এ সমস্ত মহিলাদের থেকে সুবিধা ভোগ করত। প্রচুর সংখ্যক যুবতী ও বিধবা মহিলা দখলদার সেনাদের সাথে অবৈধ দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। আমেরিকা ও ব্রিটেনের অধিকাংশ সৈন্য তাদের সাথে অবৈধ দৈহিক মেলামেশা করে বিনিময়ে তাদেরকে সিগারেট, চকোলেট বা রুটি প্রদান করত। ছোট্ট বাচ্চারা এ উপহার গুলো পেয়ে খুশি হত। ১০ বছর বয়সী একজন শিশু সমবয়সী শিশুদের কাছে এ ধরণের উপহার দেখে আকাংখ্যা করত কোন ইংরেজ যদি তার মাকে এ ধরণের কিছু দিত তাহলে, তারা ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত।৬২
আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্ন করি- নারীর জন্য কোনটা কল্যাণকর? স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ যেটার প্রচলন রয়েছে লাল হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে; নাকি সভ্যতার দাবিদার পশ্চিমা সেনাদের মত ব্যভিচার? অন্য কথায়, কোন সিস্টেমটা নারীর জন্য সন্মানের আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত কুরআনের বিধান নাকি রোমান সাম্রাজ্যের জারিকৃত বিধান?
১৯৪৮ সালে জার্মানীর মিউনিখে " পুরুষের চেয়ে নারী বেশী হয়ে যাওয়ার সমস্যা" নিয়ে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যোগদানকারীদের মাত্র কয়েকজন বহুবিবাহের পক্ষে মত দেয়া ছাড়া তারা আর কোন সমাধানে পৌছতে পারে নাই। অন্যরা তাদের মতের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। পরে এটার উপর গবেষণা করে তারা সবাই একমত হল যে, এটা ছাড়া উদ্ভুত সমস্যার আর কোন সমাধান নেই; এটাই একমাত্র সমাধান। পরে কনফারেন্স থেকে পরবর্তীতে বহুবিবাহকে সমর্থন করে মতামত প্রদান করা হয়।৬৩
বর্তমান বিশ্ব ব্যাপক ধ্বংসাত্বক অস্ত্রে ভরপুর। আজ হোক কাল হোক অচিরেই ইউরোপীয় খৃষ্টানরা বহুবিবাহকে তাদের সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মেনে নেবে। এ বাস্তবতাকে বুঝতে পেরেছেন পন্ডিত "হিলমান"। তিনি বলেন: ধ্বংসাত্বক অস্ত্র (পরমানু ও রাসায়নিক পদার্থ প্রভৃতি) ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে পুরুষ ও নারী জাতির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হবে। ফলে, বহুবিবাহ প্রথা অবলম্বন করা জরুরী হয়ে পড়বে; অন্যথায় জাতি চরম সংকটে পড়ে যাবে। এ অবস্থায় ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ও গীর্জা নতুন নতুন সিদ্ধান্ত ও কারন দেখিয়ে "বিবাহ" সম্বন্ধে নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু করবে"।৬৪
বহুবিবাহ আজকাল সমাজের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে দেখা দিয়েছে। কুরআনে বহুবিবাহের যে শর্ত দেয়া হয়েছে আজকাল পশ্চিমা সমাজে আফ্রিকার তুলনায় বেশী পরিমাণে প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ- আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। তাদের মধ্যকার গড়ে প্রতি ২০ জনে একজন যুবক তার ২১ তম বছর পুর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়।৬৫
তাদের অনেকেই হত্যার শীকার হয়; অন্যরা অকর্মন্য, কারারুদ্ধ বা মদ্যপ হয়ে থাকে।৬৬ এ ছাড়াও প্রতি চারজন মহিলার একজন ৪০ বছর বয়সেও অবিবাহিত থাকে। আর শেতাঙ্গদের মধ্যকার প্রতি দশজনে একজন অবিবাহিত থাকে।৬৭
অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ২০ বছরের আগেই সন্তানের মা হয়ে যায় এবং তারা ভরনপোষণের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়। এর ফলে, একজন বিবাহ করে অথচ, তার স্ত্রী তা জানে না।৬৮
এ সমস্যা মোকাবেলা করতে আফ্রো-আমেরিকানদেরকে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।৬৯
সে সমাজের প্রতিটি সম্প্রদায় " অংশীদারিত্বের বিবাহ" (পুরুষ কাউকে বিবাহ করবে অথচ, স্ত্রী তা জানবে না) বৈধতার পক্ষে একমত হয়েছে যা স্ত্রী ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এ সমস্যা নিয়ে ১৯৯৩ সালের ২৭ শে জানুয়ারী "টেম্পল ফিলাডেলফিয়া" বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কনফারেন্স হয়েছে।৭০
অনেকেই এ সমস্যার সমাধান হিসেবে বহুবিবাহের বৈধতা প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তারা বিশেষভাবে যে সমাজে ব্যভিচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল সেখানে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ না করার ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জনৈক মহিলা বললেন: আফ্রো-আমেরিকানদের উচিত আফ্রিকাকে অনুসরণ করা যারা বহুবিবাহকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
রোমান ক্যাথলিক এনথ্রোপোলজী (নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান) বিশেষজ্ঞ "ফিলিপ কালব্রাইট" তার " বর্তমান যুগে বহুবিবাহ" নামক গ্রন্থে (যা খৃষ্টানদের মাঝে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে) লেখেন: আমেরিকান সমাজের বহু সমস্যার সমাধান রয়েছে বহুবিবাহের মধ্যে। এটা তালাক সমস্যার সমাধান করবে যা শিশুদের উপর অতিমাত্রায় খারাপ প্রভাব ফেলে। আমেরিকান সমাজের অধিকাংশ তালাকের ঘটনা ঘটে থাকে নারী পুরুষের মধ্যকার অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপকতার ফলে। এ সমস্যাসমুহের সমাধানকল্পে বহুবিবাহ প্রথাকে বৈধ করা জরুরী। তালাকের চেয়ে এ পন্থাটা উত্তম। শিশুদেরকে রক্ষা করার জন্য এটা সর্বোত্তম পন্থা। তিনি আরো বলেন: সমাজে পুরুষ কম থাকার কারণে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীরা যে সমস্যার সন্মুখীন হচ্ছে বহুবিবাহ এ সমস্যার পরিসমাপ্তি ঘটাবে। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে প্রচলিত "অংশীদারী বিবাহ" (স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে আগের স্ত্রীর অজান্তে) করার কোন প্রয়োজন হবে না।৭১
১৯৮৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়েছিল নারীর সংখ্যা কম থাকায় "আইন কর্তৃক পুরুষকে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে" অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বহুবিবাহের পক্ষে মতামত প্রদান করে। একজন ছাত্রী বলল: তার (তার স্বামী বহুবিবাহ করলে)জন্য উত্তম হবে; এবং তার মানসিক চাহিদা পুরনে সহায়ক হবে।৭২
আমেরিকাস্থ "মর্মন" নামক ধর্মগোষ্টির একদল মহিলা বহুবিবাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কেননা, স্ত্রীরা সন্তান লালন-পালনে সহযোগিতা করে থাকে।৭৩
ইসলামে বহুবিবাহ হয় উভয়পক্ষের ঐক্যমতে। কারো অধিকার নেই কোন মহিলাকে বিবাহিত পুরুষের সাথে জোর করে বিবাহ দিবে। মহিলারও অধিকার আছে সে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করবে।৭৪
কিন্তু, বাইবেলে একদিকে বহুবিবাহের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে স্বামীর ভাইয়ের সাথে(বিবাহিত হলেও) যখন বিধবা মহিলা সন্তানহীনা হয়। (দেখুন: বিধবার সমস্যা সংকুল জীবন)
মহিলার কোন অধিকার নেই তার স্বামীর ভাইয়ের সাথে বিবাহ বসায় দ্বিমত করার। (জেনেসিসঃ ৩৮/৮-১০)
উল্লেখ্য যে, মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে বহুবিবাহ তেমন খুব একটা চোখে পড়ে না। কেননা, নারী পুরুষের সংখ্যার মধ্যকার পার্থক্যটা উদ্বেগজনক নয়। তাই, আমরা বলতে পারি যে, পশ্চিমাদের অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপকতার তুলনায় মুসলিম বিশ্বে বহুবিবাহের সংখ্যা অতি নগণ্য।
বিখ্যাত প্রটাস্টানী খৃষ্টান "বেলী গ্রাহাম" বলেন: সমাজকে বাচিয়ে রাখার স্বার্থেই বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করা খৃষ্টানদের উচিত হবে না। ইসলাম সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্যেই বহুবিবাহকে বৈধ করেছে এবং নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে জীবনসঙ্গীকে বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছে। খৃষ্টান সমাজের প্রত্যেক পুরুষ একটি মাত্র বিবাহ করে ঠিকই কিন্তু, পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যকার অবৈধ সম্পর্কের সংখ্যা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবেই দয়া ও উদারতার ধর্ম ইসলাম পুরুষকে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিলেও পুরুষ মহিলার মধ্যকার গোপন সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্যভিচারের মরণ ছোবল থেকে সমাজকে বাচিয়ে রাখতে। এবং, সমাজের স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখার গ্যারান্টি দিয়েছে। ৭৫
কিন্তু, অনেক মুসলিম ও অমুসলিম দেশ আজ বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এমনকি সেখানে প্রথম স্ত্রীর অনুমতিতে হলেও দ্বিতীয় বিবাহ আইনানুগ অবৈধ বিবেচিত হয়। তবে, স্ত্রীর অজান্তে বা তার সাথে প্রতারণা করে অপর মহিলাকে বিবাহ করা আইন অনুযায়ী বৈধ। এ ধরণের দ্বিমুখী আইনের স্বার্থকতা কী? আইন কি মানুষের সাথে খেয়ানত ও প্রতারণাকে বৈধতা দেয়ার জন্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে? বর্তমান সময়ে সভ্যতার দাবিদারদের দ্বিমুখী নীতিসমুহের মধ্যে এটাও একটা আজব নীতি।
পর্দা বিধান
সর্বশেষে, আসুন! আমরা পশ্চিমা বিশ্ব নারীদের উপর কঠোরতার প্রমান হিসেবে যে পর্দা বিধান নিয়ে আপত্তি তুলে সেটা সম্বন্ধে আলোচনা করি। খৃষ্টান বা ইহুদী ধর্মে কি পর্দার কোন বিধান নেই? ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের "বাইবেল শিক্ষা" বিভাগের প্রফেসর ড. মিনাখিম এম. ব্রায়ার তার গ্রন্থ " ইহুদীদের আইনে ইহুদী মহিলা" তে লিখেছেন: "ইহুদী মহিলারা মাথা ঢেকে বাইরে যেতেন। মাঝে মাঝে তা একটি চক্ষু ছাড়া তাদের পুর্ণাংগ চেহারা ঢেকে ফেলত"।৭৬
তিনি তার কথার প্রমাণ দিতে গিয়ে পুর্ববর্তী বিখ্যাত ইহুদী পন্ডিতদের কথা নিয়ে এসেছেন। তন্মধ্যে- "ইয়াকুব (আঃ) এর কন্যাগণ মাথা খোলা রেখে রাস্তায় বের হতেন না"। ওই পুরুষের উপর লা'নত(অভিশাপ) যে তার স্ত্রীকে খোলা মাথায় রাস্তায় ছেড়ে দেয়। কোন মহিলা সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্যে মাথার চুল ছেড়ে দিলে তা দারিদ্রতার কারণ হয়"। ইহুদী পন্ডিতদের আইন অনুযায়ী বিবাহিত মহিলার উপস্থিতিতে (যে তার চুল অনাবৃত রেখে দিয়েছে) নামাজের ভিতরে বা বাইরে ধর্মগ্রন্থ আবৃত্তি করা নিষিদ্ধ। মাথা অনাবৃত রাখাকে উলংগ হিসেবে গণ্য করা হয়।৭৭
প্রফেসর ড.মিনাখিম এম. ব্রায়ার আরো বলেন: " টান্নাইটিক যুগে যে সমস্ত ইহুদী মহিলা মাথা অনাবৃত রাখত তাদেরকে বেহায়া হিসেবে গণ্য করে ৪০০ দিরহাম করে জরিমানা করা হত"। তিনি আরো বলেনঃ ইহুদীদের এই হিজাব (পর্দা) শুধুমাত্র তাদের ভদ্রতারই পরিচায়ক হত না বরং, এটা বিলাসিতা ও পার্থক্যকারী বিবেচিত হত। হিজাব পরলে বুঝা যেত যে, এ মহিলা ভদ্র,উচ্চ বংশীয় এবং সে স্বামীর অধিকারভুক্ত পণ্য নয়।৭৮
হিজাব মহিলার সামাজিক মর্যাদারই পরিচয় বহন করে এবং তার মর্যাদাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মহিলারা হিজাব পরত যেন তাদেরকে উচ্চ বংশীয়দের মত দেখায়। হিজাব ভদ্রতার পরিচায়ক হওয়ার কারণে পুরাতন ইহুদী সমাজে ব্যভিচারী মহিলাদের হিজাব পরিধানের অনুমতি ছিল না। তাই, নিজেদেরকে সতী প্রমান করতে তারা বিশেষ ধরণের স্কার্ফ ব্যবহার করত।৭৯
ইউরোপের ইহুদী মেয়েরা উনবিংশ শতাব্দীতে তাদের জীবন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পর্দা মেনে চলত। ইউরোপের সমাজব্যবস্থা অনেককে পর্দা খুলতে বাধ্য করেছে। অনেক ইহুদী নারী তাদের মাথায় পরচুলা লাগিয়ে মাথাকে সুন্দরভাবে প্রদর্শন করার চেয়ে পর্দা বিধান পালন করাকে উত্তম মনে করেন। কিন্তু, এখন অধিক ধার্মিকা ইহুদী নারীরা তাদের উপাসনালয় ছাড়া অন্য কোথাও চুল ঢেকে রাখেন না।৮০
তাদের কেউ কেউ এখনও পরচুলা ব্যবহার করে থাকেন।৮১
খৃষ্টানদের বিশ্বাস কি আসুন সেটা জেনে নিই। এটা প্রসিদ্ধ যে, ক্যাথলিক খৃষ্টান যাজক মহিলাগন শত শত বছর ধরে পর্দা বিধান মেনে চলছেন। পর্দা সম্বন্ধে নতুন নিয়মে (new testament) পোল বলেছিলেন: " আমি চাই তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, প্রত্যেক পুরুষের মাথাই যীশু। আর প্রত্যেক মহিলার মাথাই পুরুষ এবং যীশুর মাথা যেন স্রষ্ঠা। কোন পুরুষ ইবাদত বন্দেগী করা অবস্থায় তার মাথায় কিছু থাকলে তার মাথাকে অপদস্থ করা হবে। পক্ষান্তরে, কোন মহিলা খালি মাথায় ইবাদত বন্দেগী করলে তার মাথাকে অপদস্থ করা হবে। মাথাকে অপদস্থ করা মানে মাথার চুল কামিয়ে দেয়া। অতএব, কোন মহিলা মাথা ঢেকে না রাখলে তার মাথার চুল কামিয়ে দিতে হবে। যদি কোন মহিলার জন্য তার মাথার চুল কামিয়ে ফেলা অপমানজনক মনে হয়; তাহলে সে যেন তার মাথা ঢেকে রাখে। আর পুরুষের মাথা স্রষ্ঠার প্রতিচ্ছবি হওয়ার কারণে মাথা ঢেকে রাখা উচিত নয়। মহিলারা স্বামীর সন্মানের প্রতিচ্ছবি। কারণ, পুরুষ মহিলা থেকে নয় বরং, মহিলা পুরুষ থেকে। পুরুষ মহিলার জন্য সৃজিত হয় নাই বরং, মহিলা পুরুষের জন্য সৃজিত হয়েছে। তাই, ফেরেশতার খাতিরেই তার মাথার উপরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।(১,করিন্থিয়ান্স:১১/-১০)
পোলের পর্দা বিধান ঘোষণার মূল কারণ হচ্ছে- স্রষ্ঠারুপী পুরুষের সন্মান রক্ষা করা। কেননা,পুরুষ থেকে এবং পুরুষের জন্যেই তার জন্ম হয়েছে। বিশিষ্ট ধর্ম যাজক টারটোলিয়ান তার বিখ্যাত গ্রন্থ " নারীর পর্দা" তে লিখেছেন: নারীদের উচিত রাস্তাঘাট, গীর্জা, নিজ ভাতৃবর্গ ও বেগানা পুরুষদের সামনে হিজাব (পর্দা) পরিধান করা। বর্তমানেও ক্যাথলিক খৃষ্টানদের নিয়ম হচ্ছে- মহিলাগন গীর্জার ভিতরে অবশ্যই তাদের মাথা ঢেকে রাখবে।৮২
আমিশ, মিনোনাইট প্রমুখ খৃষ্টানগণ আজও হিজাব পরিধান করে থাকেন। পর্দা সম্বন্ধে গীর্জার পাদ্রীগণ বলে থাকেন যে, "পর্দা হল নারীর স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও স্রষ্টার আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। এ কথাটা নতুন নিয়মে (new testament) পোল নিজেই বলে গেছেন।৮৩
এ সমস্ত প্রমানাদি দ্বারা স্পষ্টতঃ বুঝা যায় যে, পর্দা ইসলাম কর্তৃক নির্দেশিত নতুন কোন বিধান নয়। বরং , ইসলাম শুধুমাত্র পর্দার বিধান পালনের জন্যে তাগিদ দিয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মু'মিন নারী ও পুরুষদেরকে দৃষ্টি অবনত রাখা ও চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। মহিলাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে তাদের বক্ষদেশের উপরে আবরণ ছেড়ে দিতে। আল্লাহ বলেন:
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ (30) وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ-
অর্থাৎ, হে নবী (সাঃ)! মু'মিন পুরুষদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনমিত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতা স্বরুপ। নিশ্চয় তাদের কর্মকান্ড সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা সম্যক অবগত। আর মু'মিনা মহিলাদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনমিত করে রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রদর্শন না করে; তারা যেন তাদের বক্ষদেশের উপর আবরণ ফেলে দেয়। (সূরা নূরঃ ৩০-৩১)
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন জানিয়ে দিয়েছে যে, পর্দা নারীকে রক্ষা করে এবং তা তার সতীত্ব রক্ষায় সহায়ক হয়। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে-চরিত্রের নিষ্কলুষতার প্রয়োজনীয়তা কি? আল কুরআন নিজেই এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا (59)
অর্থাৎ,হে নবী (সাঃ)!আপনার স্ত্রী,কন্যা ও ঈমানদার নারীগণকে বলে দিন তারা যেন তাদের চাদরের অংশ বিশেষ তাদের নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব: ৫৯)
চরিত্রের নিষ্কলুষতা নারীকে অনাকাংখিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা করে। ইসলামে পর্দার বিধান প্রনয়নের হিকমত তথা কারণ হচ্ছে- নারীকে রক্ষা করা।
ইসলামে পর্দার বিধান খৃষ্টানদের আকীদার পুরোপুরি বিপরিত। এটা পুরুষের সন্মান বা তার আনুগত্যের দলীল নয়। এটা ইহুদীদের আকীদা-বিশ্বাসের বিপরীত; এটা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার পার্থক্যকারীও নয়। বরং, তা প্রত্যেক মুসলিম নারীর সন্মান ও সচ্চরিত্রের গ্যারান্টি স্বরুপ। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নারীর সন্মান ও মর্যাদা রক্ষার দিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। যে নারীদের সন্মানের হানি ঘটাতে আসবে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (4)
অর্থাৎ, আর যারা সতী স্বাধী মহিলাদেরকে অপবাদ দেয় অতঃপর চারজন স্বাক্ষী হাজির করতে না পারে তাদেরকে ৮০ টি বেত্রাঘাত কর; কখনও তাদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর ওরাই পাপাচারী।(সূরা নূরঃ ৪)
এবার তাহলে আসুন! আমরা আল কুরআনের এ শাস্তি ও বাইবেলের শাস্তির মাঝে তুলনামুলক বিশ্লেষণ করি। বাইবেলে এসেছে- "যখন কোন পুরুষকে কোন অবিবাহিত মহিলার(যার বিবাহের এখনও প্রস্তাব আসেনি) সাথে অশ্লীলতায় লিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যাবে তখন উক্ত পুরুষ মহিলার পিতাকে ৫০ টি রৌপ্য মুদ্রা প্রদান করবে এবং তার চরিত্র হননের ফলস্বরুপ তাকে বিবাহ করবে; কখনও তাকে তালাক দিতে পারবে না। (ডিউটারনমী:২২/২৮-৩০)
এখানে কাকে শাস্তিটা দেয়া হল? পুরুষকে যে জরিমানা স্বরুপ নারীর পিতাকে ৫০টি স্বর্ণমুদ্রা দেবে নাকি উক্ত মহিলাকে যাকে উক্ত পুরুষের সাথে বিবাহ ও আজীবন ঘর-সংসারে বাধ্য করা হবে? কোন বিধান নারীর সন্মান ও মর্যাদা রক্ষায় অগ্রগণ্য কুরআনের কঠিন বিধান না বাইবেলের লঘু শাস্তি?
পশ্চিমাদের কেউ কেউ "নারীদের রক্ষায় তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতার অবদান" নিয়ে রীতিমত ঠাট্টা বিদ্রুপ করে থাকে। তাদের দাবি হল "নারীর সন্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সর্বাধিক ভূমিকা রাখে শিক্ষা, শিষ্টাচার ও সভ্যতা"।
ভালো কথা; কিন্তু, এটাই যথেষ্ট নয়।যদি সভ্যতাই নারীদের সন্মান ও মর্যাদা রক্ষায় যথেষ্ট হত তাহলে, কেন উত্তর আমেরিকায় নারীরা একাকী রাস্তায় বা নির্জন এলাকায় চলতে পারে না? আর যদি শুধুমাত্র শিক্ষাই তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে তাহলে, কুইন ইউনিভার্সিটির মত প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নারীদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় গন্তব্যে পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়? শুধুমাত্র শিষ্টাচারই যদি তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারত তাহলে, আমরা প্রতিনিয়ত নারীদের ধর্ষণ ও উত্যক্ত করার মত যে সমস্ত ঘটনার সংবাদ পাচ্ছি তার অধিকাংশই কর্মস্থলে ঘটছে কেন?
বিগত কয়েক বছরের ধর্ষণ ও নারীদের সন্মানহানির যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে জড়িতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিব্গ হচ্ছে: নৌবাহিনী, অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিনেট সদস্য, উচ্চ আদালতের বিচারক, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি। কুইন ইউনিভার্সিটির মহিলা বিভাগের ডীন কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট পড়ে আমি তো তা নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। প্রকাশিত রিপোর্ট নিম্নরুপ:-
* প্রত্যেক ৬ মিনিটে কানাডায় একজন মহিলার উপর আক্রমণ হয়।
* কানাডার প্রত্যেক ৩ জন মহিলার মধ্যকার ১ জন এ আক্রমণের শিকার হয়েছে।
* প্রত্যেক ৪ জন মহিলার একজন ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার সন্মুখীন হয়েছে।
* প্রত্যেক ১-৮ জন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণের শিকার হয়।
* গবেষণায় দেখা গেছে যে, কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় লেবেলের ৬০% ছাত্র অচিরেই এ ধরণের কাজ করবে। যদি নিশ্চিত থাকে যে তাকে এ কাজের জন্য অচিরেই কোন শাস্তির সন্মুখীন হতে হবে না।
আজ আমাদের সমাজে ভুলপ্রথা ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে যার শিকড়সহ সংস্কার প্রয়োজন। পুরুষ ও নারী উভয়ের মান-সন্মান ও চরিত্রের নিষ্কলুষতার দাবী পোশাক,কথাবার্তা ও আচার-আচরণ প্রভৃতি সবকিছুতেই। অন্যথায় অবস্থা আরও বেগতিক হবে এবং মহিলাদেরকে আরও বেশী খেসারত দিতে হবে। এবং আমাদেরকে আরও বেশী দুঃখ পেতে হবে। খলীল জাবরানের একটা বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন: " যে কোন প্রকার সমস্যায় পতিত হয়েছে সে আর যে সমস্যার জরীপ করেছে তারা উভয়ে সমান নয়"।৮৪
আজ ফ্রান্স হিজাব পরিহিতা মহিলাদেরকে যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়ন করছে তা তাদের নিজেদের দেশের জন্যেই বিপদ ডেকে আনবে।
বর্তমান যুগে যখন কোন ক্যাথলিক খৃষ্টান মহিলা হিজাব পরে তখন তা সে স্বামীর সন্মানের জন্য পরিধান করেছে বলে পবিত্র গণ্য হয়; পক্ষান্তরে একই হিজাব যখন কোন মুসলিম মহিলা তার নিজের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পরে থাকে তখন তা "নারীর উপর অত্যাচার" বলে ধর্তব্য হয়।
শেষ কথা
অমুসলিমদের মধ্যকার যারা এ গবেষণার পুর্বেকার সংস্করণ পড়েছেন তাদের পক্ষ থেকে একটা প্রশ্ন করা হয়। সেটা হল- ইসলামী সমাজে মুসলিম নারীদের সাথে কি এখন এ রকম ব্যবহার করা হয়? উত্তরটা খুবই দুঃখজনক "না"। এ প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছুটা আলোকপাত করব যাতে ইসলামে নারীদের অধিকারটা পূর্ণাংগভাবে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
মুসলিম বিশ্বে মহিলাদের সাথে কৃত ব্যবহারের পন্থায় একটা সমাজ থেকে অন্য সমাজ এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মাঝে পার্থক্য থাকে। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধান সকল সমাজই পালন করে থাকে। অধিকাংশ মুসলিম সমাজই মহিলাদের সাথে ব্যবহারের বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে, দুটি দলের আবির্ভাব ঘটেছে।
এক. কট্টরপন্থি ও অন্ধ অনুকরণকারী।
দুই. স্বাধীন ও পশ্চিমাদের অনুকরণ কারী।
প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত লোকেরা পুর্বকালের প্রাপ্ত রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে থাকে। এ ধরণের রীতিনীতির কারণে নারীরা ইসলাম স্বীকৃত অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে, কোন বিষয়ে পুরুষের থেকে মহিলাদের উপর ভিন্ন ভিন্ন আইন কানুন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত নেক্কার জনক রীতিনীতি চালু হয়ে গেছে। যেমন: পুত্র সন্তান জন্মের মত কন্যা সন্তান জন্মের সময় তাকে স্বাদরে গ্রহণ করা হয় না। কখনও কখনও তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা বা উত্তরাধীকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়। পুত্র সন্তান থেকে যে সমস্ত অযাচিত কাজকে মেনে নেয়া হয় কন্যা সন্তান থেকে তা মেনে নেয়া হয় না; তাদেরকে কড়া নজরদারীতে রাখা হয়। কখনও বা এ সমস্ত কাজকর্মের কারণে তাদেরকে হত্যা করা হয়। পক্ষান্তরে, একই কাজ করে পুত্র সন্তানেরা গর্ব করে থাকে। পরিবার বা সমাজের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মতামত গ্রহণ করা হয় না। হয়তবা অনেক ক্ষেত্রে তার নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পদে বা বিবাহের উপহার ব্যবহারে তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয় না।
স্ত্রীরা পুত্র সন্তান জন্ম দেয়াকে প্রাধান্য দেয় যাতে সমাজে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে কিছু মুসলিম সমাজ বা গোত্রে পশ্চিমা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। এ সমাজগুলো সব কাজে পশ্চিমাদের রীতিনীতি ও কৃষ্টি কালচারগুলোর অন্ধ অনুকরণ করছে। এমনকি তাদের অসভ্য কালচারকেও বাদ দিচ্ছে না। এ সমস্ত মডার্ণ সমাজের বিশেষ করে মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করা। সর্বদা তারা ব্যস্ত থাকে এবং গুরুত্ব দেয় তাদের নিজেদের সৌন্দর্য বর্ধন ও প্রদর্শনের কাজে। বিবেক বুদ্ধির দিকে তাদের খেয়াল নেই। সমাজের জন্য কাজকর্ম বা কাজে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে অপরকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতাকেই বেশী বড় করে দেখা হয়। তার ব্যাগে কুরআন শরীফ পাওয়া না গেলেও সর্বদা তাতে মেকআপ বা প্রসাধন সামগ্রী শোভা পায়। সে তার রুহানী সৌন্দর্যকে গোপন করে এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার জীবন কেটে যায় নিজের নারীত্বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মনুষত্বের দিকে নয়।
কেন মুসলিম সমাজ ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুবই কঠিন। বিশেষ করে নারীদের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের ব্যাপারে কুরআনের শিক্ষা থেকে যুগ-যুগান্তরে মুসলমানদের দূরে থাকার ব্যাখ্যা দিতে গেলে আরেকটি গবেষণার প্রয়োজন হবে। মুসলমানদের যার উপর থাকার দরকার তার উপর মুসলমানরা নেই এটা একটা প্রচন্ড সমস্যা। এ সমস্যা একদিনে আসেনি বরং তা যুগ পরম্পরায় দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বে এ সর্বনাশী সমস্যার কুপ্রভাব জীবনের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আইনের ক্ষেত্রে বৈষম্য, অনৈক্য, অর্থনৈতিক ধ্বস, সামাজিক জুলুম, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চাদপসরতা ও চিন্তাভাবনার মন মানসিকতা না থাকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত সমস্যার কারণে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ইসলামের সাথে নারীদের যেন কোনই সম্পৃক্ততা নেই। আগেকার নারীরা যেমন ছিলেন বর্তমান যুগের নারীদেরকেও সেই স্থানে পৌছে দেয়া এবং সমাজ সংস্কার করা অত্যন্ত আবশ্যক। আর এই সংস্কারের জন্যেও ইসলামের শিক্ষা মেনে চলা জরুরী।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আজ মুসলিম বিশ্বে নারীদের এ লাজুক অবস্থানে থাকার কারণ হল ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও ভূল বুঝাবুঝি। মুসলমানরা সমস্ত সমস্যার সন্মুখীন হয়েছে ইসলামের সঠিক শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই গবেষণামুলক লেখাটির উদ্দেশ্য কিন্তু, ইহুদী ও খৃষ্টানদের আকীদা-বিশ্বাসকে খাট করার জন্যে নয়। ইহুদী ও খৃষ্টানদের আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী নারীদেরকে যে পজিশনে রাখা হয়েছে তা যুগের বিবর্তনে নিছক সামাজিকতা ও ইহুদী-খৃষ্টান পুরোহিতদের নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার কারণে। এরা সমাজে নারীদের ন্যায্য অধিকার গুলোকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
বাইবেল যুগের আবর্তনে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন লোক দ্বারা লিখিত হয়েছে। তাদের পারিপার্শিক অবস্থার ভিন্নতা ও মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে তাদের মতামত বিভিন্ন রকম হয়ে তাদের হাতে বাইবেল পরিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ- পুরাতন নিয়মে বর্ণিত ব্যভিচারের শাস্তি নিয়ে মহিলাদের উপর নির্ধারিত শাস্তি এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে যে, তা সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে না। তবে, প্রাচীন ইহুদী সমাজের লোকেরা নিজেদের বংশ দ্বারা গৌরব করত। এ জন্য তাদের চিন্তা ছিল কোন নারী যেন অন্য কোন শক্তিশালী গোত্রের লোকদের সাথে কোন ধরণের সম্পর্ক রাখতে না পারে। এ সমস্ত বিধানের সামনে আমরা সহানুভুতি দেখাতে পারি না। বরং আমাদের কাছে মনে হয় যে, এটা নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের একগুয়েমী ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়াও এটা ছিল নারীদের বিরুদ্ধে পুরোহিতদের নগ্ন হামলা ।নারীদের প্রতি গ্রীক ও রোমান সভ্যতার বিতৃষ্ণ মনোভাবকে উল্লেখ করা ব্যতিত বিষয়টিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সুতরাং, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা ছাড়া আমরা ইহুদী খৃষ্টান ধর্মের উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না।
ইতিহাস ও মানুষের সভ্যতার উপর ইসলামের অবদান বুঝতে হলে আমাদেরকে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের ইতিহাস জানা থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন সভ্যতা ও সমাজ ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম-বিশ্বাসের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এটা হিজরতের পূর্বে সপ্তম শতাব্দীতে তাদেরকে আল্লাহর নবী মুসা ও ঈসা (আঃ) এর উপর আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান পরিবর্তন করার পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে। ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মে নারীদের ন্যায্য অধিকারের মধ্যে একগুয়েমি করার এ বিধান সপ্তম শতাব্দীর সে পরিবর্তনেরই উদাহরণ। তখনই মানুষকে অসৎ পথ থেকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার খোদায়ী বার্তা প্রেরণ করা জরুরী হয়ে পড়ে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ইহুদী ও নাসারাদেরকে তাদের উপর আগত দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য রাসুল পাঠানো হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন:
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (157)
অর্থাৎ, আর যারা অশিক্ষিত এই রাসুলকে অনুসরণ করেছে যাকে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পেয়েছে; তিনি তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন,তাদের জন্য উত্তম জিনিসকে বৈধ ও অপবিত্র জিনিসকে হারাম করেন,তাদের উপর থেকে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্ধিত্ব অপসারণ করেন না যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং, যারা তার উপর ঈমান এনেছে, তার সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাকে সাহায্য করেছে এবং তার সাথে নাযিলকৃত নূরের অনুসরণ করেছে, শুধুমাত্র তারাই সফলকাম। (সূরা আ'রাফ: ১৫৭)
অতএব, ইসলাম ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের প্রতিদ্বন্দী হয়ে আসে নাই বরং; আল্লাহ তায়ালার পুর্ববর্তী বিধানসমূহকে পরিপূর্ণ করার জন্যেই এসেছে।
এ গবেষণার শেষভাগে আমি মুসলিম সমাজকে আবেদন করতে চাই যে, ইসলাম নারীদেরকে যে সমস্ত অধিকার দিয়েছে তার অনেকাংশ থেকেই তারা আজ বঞ্চিত। যা পুরাতন হয়ে গেছে তার সংস্কার করা জরুরী। এটা প্রত্যেক মুসলমানেরই দায়িত্ব। মুসলিম বিশ্বের এটাও একটা দায়িত্ব যে, তারা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে নারীদের জন্য ঐক্যবদ্ধ একটা বিধান প্রণয়ন করবে। তাতে নারীদের ইসলাম সম্মত যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করে যে কোন মুল্যে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। তবে, কোন কিছু না করার চেয়ে দেরীতে হলেও কিছু করাই উত্তম। মুসলমানরা তাদের মা,বোন,কন্যা ও স্ত্রীদেরকে যদি তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান না করে তাহলে, তাদেরকে সে অধিকার এনে দেবে কে? এছাড়াও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে যে সমস্ত রীতিনীতি ও ভূল প্রচলন আমাদের মাঝে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক তাকে বর্জন করা। কুরআন কি আরবের কাফিরদেরকে তাদের পুর্বপুরুষদের কৃষ্টি-কালচারের অন্ধ অনুকরণ করার কারণে তিরস্কার করে নি? পশ্চিমা বা অন্য কোন সভ্যতা থেকে আগত কোন অশ্লীল প্রথা আমাদের মাঝে আসলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করব। তবে, তাদের থেকে যেগুলো ভালো সেগুলো গ্রহণ করব এবং তাদের সাথে সম্পর্ক রাখব। এটাই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শিক্ষা। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (13)
অর্থাৎ,হে মানবসমাজ!নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একটি মাত্র পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি; আর তোমাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যকার সর্বাধিক খোদাভীরু লোকই আল্লাহ তায়ালার নিকট বেশী সন্মানিত। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ ও সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
আমাদের কর্তব্য হবে আমরা অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠির অন্ধ অনুসরণ করব না কেননা, এটা নিজেদের সন্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী কাজ।
আর ইহুদী-খৃষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ভাইদের কাছে আমার কয়েকটি কথা রয়েছে। সেগুলো হল: যে ধর্ম নারীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করছে এবং তাদেরকে সন্মানের আসনে আসীন করছে তাকে আজ নারীর উপর জুলুমকারী বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে এটা আসলেই বিস্মিত করার মত কথা; যে বিশ্বাস আজ সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং মিডিয়া ও হোলিউড সিনেমায় যা নিয়ে রীতিমত হৈ চৈ করা হয়। ইসলাম নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি ও কোন কিছুর সাথে ইসলামের সম্পৃক্ততা নিয়ে ভীতিই এ ভুল বিশ্বাস স্থাপিত হবার অন্যতম কারণ। মিডিয়া ইসলামকে বিকৃতি করা থেকে ক্ষান্ত হলে আমরা শান্তিপুর্ণ সমাজ গঠন করতে পারব যেখানে থাকবে না কোন ভুল বুঝাবুঝি, পক্ষপাতদুষ্টতা ও সাম্প্রদায়িকতা। অমুসলিমদের জানা দরকার যে, ইসলাম স্বীকৃত বিষয় ও বর্তমান মুসলমানদের কাজকর্মের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এগুলো ইসলাম বলে স্বীকৃত হতে পারে না। সুতরাং, আজকের মুসলিম সমাজে নারীদের মর্যাদা ও ইসলামে নারীদের মর্যাদার ভিতরে আকাশ পাতাল তফাত আছে ঠিক তেমনি যেমন তফাত আছে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মে নারীদের মর্যাদা ও পশ্চিমা সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত নারীদের মর্যাদার ভিতরে। তাই, মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের উচিত বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যত শান্তির লক্ষ্যে ভুল বুঝাবুঝি, ভীতি ও সন্দেহ ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা করা।
আর এটা স্পষ্ট করা দরকার যে,ইসলাম নারীদেরকে সন্মান দিয়েছে এবং তাকে এমন সব অধিকার দিয়েছে যা দেড় হাজার বছর পরে এখন সবেমাত্র বিশ্ব বুঝতে পেরেছে। ইসলাম নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্মান-মর্যাদা ও সর্বপ্রকার বিপদ থেকে বেচে থাকার গ্যারান্টি দেয়। ইসলাম তাকে আত্মিক, বাহ্যিক, চিন্তা ও ইচ্ছাসহ সমস্ত প্রয়োজনকে মিটিয়ে দেয়। আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, বর্তমানে বৃটেনে যারা মুসলমান হচ্ছে তাদের অধিকাংশই মহিলা। অপরদিকে আমেরিকায় ইসলাম গ্রহণকারী মহিলার সংখ্যা পুরুষের চেয়ে চারগুন বেশী।৮৫
তাই, বর্তমান বিশ্ব সঠিক পথের দিশা পেতে ইসলামের অত্যন্ত মুখাপেক্ষী। ১৯৮৫ সালের ২৪ শে জুন আমেরিকান কংগ্রেসের বৈদেশিক বিভাগের এক বৈঠকে "রাষ্ট্রদুত হিরমান এইলটস" বলেছিলেন: বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ১০০ কোটির ও বেশী এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু, আমি আশ্চর্য হই যে, ইসলাম একত্ববাদে বিশ্বাসী অত্যন্ত দ্রুত বর্ধমান একটি ধর্ম; এটা যদি কোন কিছুর দিকে ইংগিত দেয় তাহলে তা হবে-ইসলাম হল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম। এটা প্রচুর সংখ্যক নেককার লোকদেরকে তার দিকে আকৃষ্ট করছে।"
হা, ইসলাম সত্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত;এবং তা প্রমাণিত হওয়ার সময়ও এখনই। আশা করি আমার এই গবেষণা এ পথে একধাপ এগিয়ে দেবে ইনশাল্লাহ।
সহায়ক গ্রন্থাবলী
1. The globe and mail, oct. 4, 1994
2. Leonard j.swidlar, women in Judaism: the status of women in formative Judaism (Metuchen, N.J: Scarecrow press, 1976) p.115
3. Thena kendath, "memories of an orthodox youth" in Susannah heschel, ed. On being a jewish feminist (New york: schocken books, 1983), pp.96-97
4. Swidler, op. cit., pp. 80-81.
5. Rosemary R. Ruether, "Christianity", in Arvind Sharma, ed.,
Women in World Religions (Albany: State University of New
York Press, 1987) p. 209.
6.For all the sayings of the prominent Saints, see Karen
Armstrong, The Gospel According to Woman (London: Elm
Tree Books, 1986) pp. 52-62. See also Nancy van Vuuren, The
Subversion of Women as Practiced by Churches, Witch-
Hunters, and Other Sexists (Philadelphia: Westminister Press)
pp. 28-30.
7.Swidler, op. cit., p. 140.
8.Denise L. Carmody, "Judaism", in Arvind Sharma, ed., op.
cit., p. 197.
9.Swidler, op. cit., p. 137.
10­.Ibid., p. 138.
11.Sally Priesand, Judaism and the New Woman (New York:
Behrman House, Inc., 1975) p. 24.
12 .Swidler, op. cit., p. 115
13.Lesley Hazleton, Israeli Women The Reality Behind the
Myths (New York: Simon and Schuster, 1977) p. 41.
14. Gage, op. cit. p. 142.
15.Jeffrey H. Togay, "Adultery," Encyclopaedia Judaica, Vol. II,
col. 313. Also, see Judith Plaskow, Standing Again at Sinai:
Judaism from a Feminist Perspective (New York: Harper &
Row Publishers, 1990) pp. 170-177.
16. Hazleton, op. cit., pp. 41-42.
17. Swidler, op. cit., p. 141.
18. Matilda J. Gage, Woman, Church, and State (New York:
Truth Seeker Company, 1893) p. 141.
19. Louis M. Epstein, The Jewish Marriage Contract (New York:
Arno Press, 1973) p. 149.
­20. Swidler, op. cit., p. 142.
21. Epstein, op. cit., pp. 164-165.
22. Ibid., pp. 112-113. See also Priesand, op. cit., p. 15.
23. James A. Brundage, Law, Sex, and Christian Society in
Medieval Europe ( Chicago: University of Chicago Press, 1987)
p. 88.
24. Ibid., p. 480.
25. R. Thompson, Women in Stuart England and America
(London: Routledge & Kegan Paul, 1974) p. 162.
26. Mary Murray, The Law of the Father (London: Routledge,
1995) p. 67.
27. Gage, op. cit., p. 143.
28. For example, see Jeffrey Lang, Struggling to Surrender, ­
(Beltsville, MD: Amana Publications, 1994) p. 167.
29. Elsayyed Sabiq, Fiqh al Sunnah (Cairo: Darul Fatah lile'lam
Al-Arabi, 11th edition, 1994), vol. 2, pp. 218-229.
30. Abdel-Haleem Abu Shuqqa, Tahreer al Mar'aa fi Asr al
Risala (Kuwait: Dar al Qalam, 1990) pp. 109-112.
31. Leila Badawi, "Islam", in Jean Holm and John Bowker, ed.,
Women in Religion (London: Pinter Publishers, 1994) p. 102.
32 . Amir H. Siddiqi, Studies in Islamic History (Karachi:
Jamiyatul Falah Publications, 3rd edition, 1967) p. 138.
33. Epstein, op. cit., p. 196.
34. Swidler, op. cit., pp. 162-163.
35. The Toronto Star, Apr. 8, 1995.
36. Sabiq, op. cit., pp. 318-329. See also Muhammad al
Ghazali, Qadaya al Mar'aa bin al Taqaleed al Rakida wal
Wafida (Cairo: Dar al Shorooq, 4th edition, 1992) pp. 178-180.
37. Ibid., pp. 313-318.
38. David W. Amram, The Jewish Law of Divorce According to
Bible and Talmud ( Philadelphia: Edward Stern & CO., Inc.,
1896) pp. 125-126.
39. Epstein, op. cit., p. 219.
40­. Ibid, pp 156-157.
41. Muhammad Abu Zahra, Usbu al Fiqh al Islami (Cairo: al
Majlis al A'la li Ri'ayat al Funun, 1963) p. 66.
42 . Epstein, op. cit., p. 122.
43. Armstrong, op. cit., p. 8.
44. Epstein, op. cit., p. 175.
45. Ibid., p. 121.
46. Gage, op. cit., p. 142.
47. B. Aisha Lemu and Fatima Heeren, Woman in Islam
(London: Islamic Foundation, 1978) p. 23.
48. Hazleton, op. cit., pp. 45-46.
49. Ibid., p. 47.
50­. Ibid., p. 49.
51. Swidler, op. cit., pp. 144-148.
52 . Hazleton, op. cit., pp 44-45.
53. Eugene Hillman, Polygamy Reconsidered: African Plural
Marriage and the Christian Churches (New York: Orbis Books,
1975) p. 140.
54. Ibid., p. 17.
55. Ibid., pp. 88-93.
56. Ibid., pp. 92-97.
57. Philip L. Kilbride, Plural Marriage For Our Times (Westport,
Conn.: Bergin & Garvey, 1994) pp. 108-109.
58. The Weekly Review, Aug. 1, 1987.
59. Kilbride, op. cit., p. 126.
60­. John D'Emilio and Estelle B. Freedman, Intimate Matters: A
history of Sexuality in America (New York: Harper & Row
Publishers, 1988) p. 87.
61. Ute Frevert, Women in German History: from Bourgeois
Emancipation to Sexual Liberation (New York: Berg Publishers,
1988) pp. 263-264.
62 . Ibid., pp. 257-258.
63. Sabiq, op. cit., p. 191.
64. Hillman, op. cit., p. 12.
65. Nathan Hare and Julie Hare, ed., Crisis in Black Sexual
Politics (San Francisco: Black Think Tank, 1989) p. 25.
66. Ibid., p. 26.
67. Kilbride, op. cit., p. 94.
68. Ibid., p. 95.
69. Ibid.
70­. Ibid., pp. 95-99.
71. Ibid., p. 118.
72 . Lang, op. cit., p. 172.
73. Kilbride, op. cit., pp. 72-73.
74. Sabiq, op. cit., pp. 187-188.
75. Abdul Rahman Doi, Woman in Shari'ah (London: Ta-Ha
Publishers, 1994) p. 76.
76. Menachem M. Brayer, The Jewish Woman in Rabbinic
Literature: A Psychosocial Perspective (Hoboken, N.J: Ktav
Publishing House, 1986) p. 239.
77. Ibid., pp. 316-317. Also see Swidler, op. cit., pp. 121-123.
78. Ibid., p. 139.
79. Susan W. Schneider, Jewish and Female (New York:
Simon & Schuster, 1984) p. 237.
80­. Ibid., pp. 238-239.
81. Alexandra Wright, "Judaism", in Holm and Bowker, ed., op.
cit., pp. 128-129
82 . Clara M. Henning, "Cannon Law and the Battle of the
Sexes" in Rosemary R. Ruether, ed., Religion and Sexism:
Images of Woman in the Jewish and Christian Traditions (New
York: Simon and Schuster, 1974) p. 272.
83. Donald B. Kraybill, The riddle of the Amish Culture
(Baltimore: Johns Hopkins University Press, 1989) p. 56.
84. Khalil Gibran, Thoughts and Meditations (New York:
Bantam Books, 1960) p. 28.
85. The Times, Nov. 18, 1993.
86- السيد سابق، فقه السنة (القاهرة: دار الفتح للإعلام العربى، الطبعة الحادية عشر، 1994)، المجلد الثانى-
87- أمير صديقى، دراسات فى التاريخ الإسلامى (كاراتشى: جمعية الفلاح، الطبعة الثالثة، 1967)
88- عبد الحليم أبو شوقة، تحرير المرأة فى عصر الرسالة (دولة الكويت:دار القلم،1990)
89- عبد الرحمن دوى، المرأة فى الشريعة (لندن: مطابع طه، 1994)
90-محمد أبو زهرة، أسبوع الفقه الإسلامى (القاهرة: المجلس الأعلى لرعاية الفنون ،1963)
91- محمد الغزالى، قضايا المرأة بين التقاليد الراكدة و الوافدة (القاهرة: دار الشروق، الطبعة الرابعة،1992)
تمت بالخير

No comments:

Post a Comment